ময়ূরাক্ষী সেন
মাহবুব রহমান কিছুদিন আগেই চাকরিজীবন শেষ করে অবসর নিলেন। বয়স ৬১ বছর। সহধর্মিনী মারা গেছেন বছরখানেক আগে। বয়সজনিত সব ধরনের রোগই তার রয়েছে। ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিছুই বাদ নেই। চাকরিজীবনে তিনি বেশ প্রফুল্ল ছিলেন, নিয়মমাফিক ছিল তারা চলাফেরা। রোজ ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়তেন। এরপর বাসায় এসে খবরের কাগজ পড়ে নাস্তা করতেন আয়েশ করে। নাস্তা শেষ করেই ছুটতেন অফিসে। নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসতেন। কিন্তু অবসরের পর হঠাৎ তিনি কেমন জানি মনমরা হয়ে পড়েন। আগের মতো প্রফুল্ল নেই! সকালে ঘুম থেকে উঠবার মানসিক শক্তিটাও পান না তিনি। আড্ডাপ্রিয় মানুষটা হঠাৎ সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন।
অন্যদিকে তাসলিমা বেগম বয়স ৫২। মাসখানেক আগে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঘরে নতুন বউ আসবার পর তিনি খুশি নন, সর্বক্ষণ নতুন বউয়ের খুঁত চোখে পড়ছে তার। তাই তো অভিযোগের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। যেমন একটি ঘটনা যদি বলি; তার ছেলে ও ছেলেবউ একদিন সিনেমা দেখতে যাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু তার সাথে কেন পরামর্শ করে নিল না এই তার অভিযোগ। তিনি নিজেকে পরিবারের অপ্রয়োজনীয় সদস্য ও ফেলনা মনে করতে থাকেন। তিনি এই বলে কান্নাকাটি করেন যে, বিয়ের পর তার ছেলে বদলে গেছে তাকে আর প্রয়োজন নেই। এইসব মনগড়া বিষয় চিন্তা করে তিনি নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে একা করে ফেলেন। সবার সাথে প্রায় কথা বন্ধ করে দেন।
উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো কাল্পনিক হলেও এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে আমাদের আশেপাশেই। অনেক মানুষ তার জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে নানা কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে ও তাদের ঘিরে ধরে বিষণ্নতা। আমরা এই প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ও বিষণ্নতা নিয়ে আওয়াজ তুললেও খুব কম মানুষ পঞ্চাশের পরের বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলে। কারো মাথায় আসেই না যে ঠিক এ সময়টায় এসেও কারো কারো নতুন করে বিষণ্নতা শুরু হতে পারে।
পঞ্চাশোর্ধে সকলের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হলো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা.তারিকুল ইসলামের সাথে। বিষণ্নতা কি জানতে চাইলে ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষণ্নতা হলো সবচেয়ে সাধারণ ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যগত একটি অবস্থা এবং প্রায়ই উদ্বেগের পাশাপাশি এটি বিকাশ লাভ করে। বিষণ্নতা হালকা ও স্বল্পস্থায়ী বা গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।’ ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার কোনো বয়সসীমা নেই। এটি যেকোনো বয়সে যে কোনো সময় হতে পারে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বয়সন্ধিকালে বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এখন বাড়ছে বার্ধক্যে বিষণ্নতা। এদের চিকিৎসাও পিছিয়ে যায় বা অবহেলিত হয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বয়স্কদের শতকরা প্রায় ১৫ জন নানা ধরনের বিষণ্নতায় ভোগেন। আর শতকরা চারজন গুরুতর বা জটিল রকমের বিষণ্নতার শিকার। দেশে বিষণ্নতায় ভোগে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে এই হার প্রায় তিন গুণ। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে সংখ্যাটা চিন্তার কারণ বটে।
বার্ধক্যে বিষণ্নতার অনেক কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো একাকীত্ব। হঠাৎ সহধর্মিনীর মৃত্যু কিংবা সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া। অনেকের শারীরিক অসুস্থতার কারণেও বিষণ্নতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বাত-জাতীয় বিভিন্ন রকমের ব্যথা, স্ট্রোক, ডিমেনসিয়া বা স্মৃতিবৈকল্য ইত্যাদি। আবার এদের প্রায় ১৫ শতাংশ এসব শারীরিক সমস্যার সঙ্গে ডিপ্রেশন বা বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। নানা রকম রোগে আক্রান্ত হবার কারণে শরীরে আর আগের মতো কর্মক্ষমতা থাকে না, ফলে নিজেকে বোঝা ও অক্ষম ভাবতে শুরু করেন। এর ফলে জন্ম হয় বিষণ্নতাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা। এই সময়ে এসে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের কাছে তাদের প্রত্যাশা বেড়ে যায় ও তারা চায় পরিবারের সবাই তাকে গুরুত্ব দিবে, মনোযোগ দিবে। যখনই তাদের প্রত্যাশার বাইরে কিছু হয় তখনই তারা অস্থির হয়ে পড়েন ও নিজেকে গুটিয়ে নেন। এছাড়া অনেকে তাদের ফেলে আসা স্মৃতি ভুলে যেতে থাকে। ছোটবেলার সব স্মৃতি ভালোভাবে মনে থাকলেও কয়েক ঘণ্টা আগে কী করেছেন তাই হয়তো মনে করতে পারা দুষ্কর হয়ে যায়। যাকে বলা হয় ‘ডিমনেসিয়া’। এ ছাড়া জ্ঞানপ্রক্রিয়াতেও ক্ষয় দেখা যায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, মাঝে মাঝে চিন্তা ও কথার মধ্যে কিছু অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হতে পারে।
বিষণ্নতা লক্ষণ
১. আগে যেসব আগে আগ্রহ থাকতো সেইসব করার প্রতি অনিচ্ছা। ২. কোনো কারণ ছাড়াই অস্থির লাগা। ৩. দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা। ৪. ক্ষুধা কমে যাওয়া কিংবা বেড়ে যাওয়া। ৫. ঘুম কমে যাওয়া কিংবা বেড়ে যাওয়া। ৬. প্রতিনিয়ত নিজেকে দোষারোপ করা। ৭. সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। ৮. মনোযোগের অভাব। ৯. আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া। ১০. যৌনআকাক্সক্ষা কমে যাওয়া।
১১. আত্মহত্যার চিন্তা আসা।
উপরে উল্লিখিত লক্ষণ ১৫ দিন কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে থাকলে তা বিষণ্নতা বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, পঞ্চাশের পর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্য ও রোগীর নিজেকে নিজে সাহায্যে করতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রথমেই নিজেকে অক্ষম ভাবা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সে নিজেই তার জীবন পরিচালনা করে এই অবধি নিয়ে এসেছেন। আর বার্ধক্য জীবনের একটি অংশ মাত্র। প্রতিটি মানুষকে বার্ধক্যর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। বেঁচে থাকলে একে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। তাই জীবনের এই অধ্যায় মেনে নিতে হবে। এবং বার্ধক্যজনিত সব রোগ যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সে চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিয়ম করে হাঁটা, ঔষধ খাওয়া ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস। মন ভালো রাখতে বাড়িতে হালকা ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করা যেতে পারে। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতে হবে, জীবনের যেকোনো সময়েই নতুন করে সব শুরু করা যায়। তাই বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে রোজ একটু করে বই পড়তে হবে। বাগান করা যেতে পারে কিংবা নতুন কিছু রান্নার চেষ্টা। আবার নতুন কোনো ভাষা শেখা। রোজ গান শুনলে কিংবা কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করলেও মন প্রফুল্ল থাকবে। এছাড়া ছবি আঁকবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কখনো মনে করা যাবে না আমার সময় তো ফুরিয়ে এলো। বাঁচার মতো বাঁচবার চেষ্টা করতে হবে। মোট কথা, মনকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
পরিবার কিংবা কাছে কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে হবে। অনেকেই মনের কথা মনে রেখে দেয়, এতে বিষণ্নতা আরো বেড়ে যায়। তাই মনের মধ্যে কিছু আসলে তা বলে ফেলতে হবে। পরিবারের সদস্যদের উচিত নিজেদের ব্যস্ত সময় থেকে পরিবারের বয়স্ক মানুষদের জন্য সময় বের করা। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা। ছুটির দিনে তাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া কিংবা তাদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া। মাঝে মাঝে তাদের মন ভালো আছে কি না জিজ্ঞাসা করা। পরিবারের ছোট সদস্যর মতো তারাও এই সময়টা এসে যত্ন ও ভালোবাসা আশা করে। তাই তাদের অনুভব করাতে হবে তারা পরিবারে বোঝা না, তাদের মতামতের গুরুত্ব এখনো রয়েছে। তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, বিষণ্নতা যদি গুরুতর হয় তাহলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হতে হবে ও পরামর্শ নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, আমাদের দেশে শারীরিক সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও মানসিক সমস্যাকে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। দেখা যাচ্ছে, মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিলে মনে করা হয় হয়তো শরীরের অসুখ হয়েছে। তখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কোনো রোগ ধরা পড়ে না। পরবর্তীতে দেখা যায় রোগটা আসলে শরীরে নয় মনে। তাই পরিবারের বয়স্করা যদি এই সমস্যার সম্মুখীন হন তাহলে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা