মাহবুব আলম
এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। আরো আগে ঢাকা শহরকে বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। ঢাকা ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। এর মূলে ছিল ঢাকা শহরে মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শতাধিক খাল। যে খালগুলো সংযুক্ত ছিল বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালু নদীর সাথে। ঢাকার এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মুঘলরা এখানে বাংলার রাজধানী করে। কিন্তু সেইদিন সেই সময় আর নেই। নদী-খাল-জলাশয় ভরাট করে ঢাকা এখন কংক্রিটের এক জঞ্জাল স্তুপে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার সময় ঢাকা নগরের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ। সেই সময় ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। ৭১ সালে ঢাকা হয় একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। স্বাভাবিকভাবে এই নগরীতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক স্বাধীনতা পর পুরো ৭০ দশকে একে স্বাধীন দেশের রাজধানী উপযোগী করার কোনো পরিকল্পনাই গৃহীত হয়। সাবেক পাকিস্তান আমলের যে পরিকল্পনা ছিল তাও বাস্তবায়িত হয় ধীরগতিতে যথেচ্ছভাবে। ৮০’র দশকে প্রথম পরিকল্পনা করে ঢাকাকে একটি আধুনিক নগরী করার কথা বলা হয়। ৮০’র দশকে এরশাদ স্বৈরশাসনের আমলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানকে। জেনারেল সাহেব দায়িত্ব নিয়েই বলেন ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী করা হবে।
শুরু হলো আধুনিক ঢাকা নির্মাণের কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি একের পর এক খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট করে সড়ক নির্মাণের নামে নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিলেন। শুরু হলো নগরীতে জলাবদ্ধতা। সেই সাথে নগরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিশাল বিশাল গাছ কেটে শহরকে ন্যাড়া করে ফেললেন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রশাসক ও মেয়ররা একে একে ঢাকার সব জলাশয় ভরাট করে, খেলার মাঠ ধ্বংস করে মার্কেট নির্মাণের সাথে সর্বত্র কংক্রিটের জঞ্জাল তৈরি করলেন। ফলে ঢাকার ঐতিহাসিক ধুপখোলা মাঠ, আরমানিটোলা মাঠ ও পল্টন ময়দানসহ আরো অনেক মাঠ শেষ হয়ে গেছে।
এরপরও তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার গাল ভরা সেøাগানে নগরবাসিকে দিনের পর দিন প্রতারণা করা হলো। ঘটনা-দুর্ঘটনাক্রমে যা আজও অব্যাহত আছে। তাইতো দেখা যায় ৮০’র দশকের ঢাকা শহরে মাত্র দু’তিনটি জায়গায় নাকে রুমাল দিয়ে পার হতে হতো। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঠাটারী বাজারের গোস্তপট্টির পাশের রাস্তা। এ রাস্তায় চলার সময় নাকে রুমাল দিয়েও রক্ষা হতো না, রীতিমতো বমি ভাব এসে যেত পথচারী যাত্রীদের। তারপর বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে আমরা একাবিংশ শতাব্দীতে পা দিয়েছি। তাও ২৪ বছর পেরিয়ে গেল। এই দীর্ঘ সময় পরও অপরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধ ঢাকা নগরী অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধময় নগরী রয়ে গেছে।
এই দীর্ঘ সময়ে কত মেয়র এলো গেল। নগরী দুভাগ হলো। এরপরও এই নগরীতে বিভিন্ন স্থানে নাকে রুমাল দিয়ে চলাও বেশ কষ্টকর। আগে মূলত পুরান ঢাকায় অপরিচ্ছন্নতা ও দুর্গন্ধ ছিল। এখন খোদ অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে মানুষকে নাকে রুমাল দিয়ে চলতে হয়। সবচাইতে দুর্ভাগ্য এই অবস্থা তৈরি করেছে খোদ সিটি কর্পোরেশন, ময়লার ডিপো নির্মাণের নামে। নগরীর মূল সড়কের মাঝখানে ফ্লাইওভারের নিচে অথবা পাশে এই ময়লার ডিপো এখন নগরবাসীর নিত্যদিনের দুর্গন্ধ সঙ্গী হয়ে গেছে। তারপরেও বলা হচ্ছে পরিছন্ন নগরী করা হবে।
এখানে বলার দরকার পুরান ঢাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ড্রেনের পানি সরে না। ড্রেনের ওই ময়লা কালো কুচকুচে দূষিত পানিতে পা পড়লে যে কারো ঘা-পাচড়া চুলকানি হবেই। সেই সাথে নগরীর সকল রাস্তাঘাট ফুটপাতে বাদামের খোসা, সিগারেটের টুকরা, চানাচুর, চিপসের প্যাকেট, পানি ও জুসের খালি বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সার্বক্ষণিক। ফুটপাতের দোকানদাররা যেখানে বসে ফলমূল চা ইত্যাদি বিক্রি করে সেখানে তো কথাই নেই। রীতিমতো ময়লার স্তুপ জমে যায়।
আর নদী দূষণের কথা নাই বললাম। বুড়িগঙ্গায় পানির রঙই বদলে গেছে। সর্বত্র কালো কুচকুচে পানি। যারা ফেরি পারাপার হয় বা লঞ্চ স্টিমারে ওঠে তারা সর্বক্ষণ নাকে রুমাল দিয়ে রাখে। যতক্ষণ না শহর এলাকা ছেড়ে না যায়। বালু, তুরাগের অবস্থাও একই। অথচ এই শহরে আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি নারিন্দা দয়াগঞ্জের ধোলাইখালে স্বচ্ছ পানি। পাল তোলা নৌকার যাতায়াত। ইট, বালু, সিমেন্ট, লাকড়ির নৌকার আনাগোনা আর তরুণ যুবকদের খালে নদীতে সাঁতার কাটা। খুব বেশিদিনের কথা নয়। ৭০ দশকের কথা। সবশেষ। নদী খাল জলাশয় মাঠ সব শেষ। শেষ নগরীর সব গাছপালা। সেইসাথে নগরীর রাস্তাঘাটে আবর্জনার স্তুপ। তারপরও বলছি, বলা হচ্ছে পরিচ্ছন্ন নগরী করতে হবে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে কিভাবে নগরী পরিচ্ছন্ন হবে। ফুটপাতের ময়লার স্তুপ জমিয়ে ড্রেন বন্ধ করে বুড়িগঙ্গার দূষণ অব্যাহত রেখে। না এটা সম্ভব নয়। সবচাইতে বড় কথা পরিচ্ছন্ন নগরের জন্য সর্বাগ্রে চাই পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ। যে মানুষ বাসের জানালা দিয়ে পানির বোতল, চানাচুরের প্যাকেট বা চিপসের প্যাকেট ফেলবে না। প্রাইভেট কারের কাঁচের জানালা খুলে কেউ ফেলবে না জলের বোতল, জুসের প্যাকেট। সেই মানুষ কোথায়? সেই মানুষ কিভাবে পাব? তাই দেখে শুনে মনে হচ্ছে পরিচ্ছন্ন ঢাকার চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো। তাই বলছি, পরিছন্ন ঢাকা দিল্লি দূর অস্ত।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা