পরিবেশ ঋণ আরেকটি ফাঁদ হতে যাচ্ছে: ড. ফিরোজ আলম

আফরোজা আখতার পারভীন: জলবায়ু তহবিল থেকে ঋণ হিসাবে দেওয়া অর্থ আরেকটি ঋণের ফাঁদ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে অনুন্নত দেশগুলোর যে ঋণ আছে তার উপর এটি আরেকটি বোঝা হবে। ফলে ঋণ নিযে সতর্ক পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি’র প্রফেসর ড. ফিরোজ আলম। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন বা তার বেশি তহবিল সংগ্রহই হবে কপ২৭-এর অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া তাপমাত্রা ১.৫ না হলেও অন্তত ১.৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা ধরে রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা আরেকটি উদ্দেশ্য।

বিসিপিসিএল-ইপি ক্লাইমেট টকস-এ মেলবর্ন, অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্ত হয়ে তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা তহবিলের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি যেহেতু ‘নন ট্রান্সপারেন্ট অ্যাকাউন্ট সিস্টেম’ তাই কত অর্থ জমা বা খরচ হয়েছে তা বলা অত্যন্ত কঠিন। সম্প্রতি ভারতের অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ তহবিলে জমার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও কম। বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ৪৬টি উন্নয়নশীল দেশ গত ৫ বছরে এ তহবিল থেকে পেয়েছে মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। ‍অর্থাৎ প্রতিটি দেশ পেয়েছে টাকায় ২৬০ কোটি মাত্র। যদিও এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

ড. ফিরোজ বলেন, গত কপগুলোতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা তহবিল ছাড় হবে ‘বাই-ল্যাটারাল’, ‘মাল্টি-ল্যাটারাল’, ‘প্রাইভেট’ এবং ‘এক্সপোর্ট ক্রেডিট’ হিসাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ছাড় করা অর্থের মাত্র ২০ ভাগ অনুদান আর ৮০ ভাগ হলো ঋণ। আবার এর ৮০ ভাগ মিটিগেশনে আর মাত্র ২০ ভাগ এডাপটেশনে ব্যয় হচ্ছে। যদিও অনুন্নত দেশগুলোর দাবী এটা ৫০:৫০ করার।

তার আশংকা, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই এ তহবিলে অর্থ প্রদান গতি পায়নি। যুদ্ধের কারণে তহবিলে অর্থ জমার লক্ষ্য কোনোভাবেই অর্জিত হবে না। জলবায়ু তহবিল থেকে দেওয়া অর্থ আরেকটি ঋণের ফাঁদ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে অনুন্নত দেশগুলোর যে ঋণ আছে তার উপর এটি আরেকটি বোঝা হবে। ফলে এ দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত মিটিগেশন-এডাপটেশন কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কারণ সম্পদের বড় অংশ চলে যাবে মূল ঋণ এবং সুদ পরিশোধ করতে। তাই ঋণ নিয়ে মিটিগেশন-এডাপটেশন পরিকল্পনা করা ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, ফলে অনুন্নত দেশগুলোর একজোট হয়ে সম্মিলিত দাবী হওয়া উচিত, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৫০ ভাগ অর্থ এডাপটেশনের জন্য দিতে হবে। এখন একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলো যে ঋণ দিচ্ছে তাতে যদি কোনোভাবে উল্লেখ থাকে ‘পরিবেশ সহনীয়’ তাহলেই সে অর্থ জলবায়ু তহবিলের ‍হিসাবে দেখান হচ্ছে।

ড. ফিরোজ পরামর্শ দিয়ে বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কারিগরী দক্ষতা বিনিময় করতে হবে। যৌথ শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব। উন্নত দেশ কখনও এমনি এমনি কারিগরী দক্ষতা অনুন্নত দেশ পৌঁছে দেবে না। ফলে নানা প্রক্রিয়ায় কারিগরী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অনুন্নত দেশগুলোকে যেমন সংঘবদ্ধ হতে হবে তেমনি বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, পরিবেশবাদী বিজ্ঞানী, সামাজিক সচেতনতা গোষ্ঠী সবাই মিলে যৌথ দাবী তুলতে হবে যাতে করে সম্মিলিত চাপে এ তহবিলে প্রতিশ্রুত অর্থ জমা হয়।

মনে রাখতে হবে, অনুন্নত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনে কোনো ভূমিকাই নেই। উন্নত দেশগুলো গত ৩-৪শ বছর ধরে শিল্প বিপ্লবের নামে কার্বন দূষণ করছে। বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য তারাই দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার অর্থ তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে। অনুন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের অর্থ কোনোভাবেই জলবায়ু মোকাবেলায় ব্যবহার করা যাবে না। শুধু চেষ্টা করতে হবে উন্নয়ন প্রকল্পে যেন কার্বন দূষণ কম হয়।

তার মতে, বাংলাদেশ এনডিসিতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন হবে। যদিও বাংলাদেশের কার্বন দূষণ বিশ্বের তুলনায় খুবই কম। ভাবা হয়েছিল, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ান যাবে। কিন্তু অধিক জনসংখ্যার চাপে সোলার বিদ্যুতে অগ্রগতি ভালো নয়। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জমির ব্যবহার বেশি করতে হয়। বলা যায়, বাংলাদেশ উচ্চ‍াভিলাসী প্রতিশ্রুতি করেছিল। তবে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছে দেবে।

তিনি জানান, বিদ্যুৎ মাস্টার প্ল্যানে বিষয়গুলো উল্লেখ আছে। নিজস্ব গ্যাস, আমদানি করা এলএনজি এবং পরমাণু জ্বালানি নিয়ে পরিকল্পনা সঠিক। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করতে হতে পারে। আর বায়ুবিদ্যুৎ নিয়ে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eight − one =