বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এর জন্য ঝরেছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে নানা পেশার নানা বয়সের মানুষ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার একটাই আকাক্সক্ষা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে এই দেশের আলো বাতাসে জীবনধারন করে প্রতিনিয়ত দেশের কাছে ঋণী হচ্ছি আমরা। নিজের জাতিসত্তার পরিচয় জানতে হলে অবশ্যই জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আর এই ইতিহাস জানার মাধ্যম অনেক। বই পড়েও যেমন ইতিহাস জানা যায়, তেমনি জানা যায় নাটক, সিনেমা ও তথ্যচিত্র দেখেও। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। আর এসব চলচ্চিত্র নিয়ে মাসুম আওয়ালের প্রতিবেদনে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে রঙবেরঙ। এ পর্বে আমরা আলো ফেলবো ‘পিতা’ চলচ্চিত্রে।
মুক্তির আলোয়
‘পিতা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন মাসুদ আখন্দ এবং পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ১২৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রটি মুক্তির আলোয় আসে ২০১২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পিতা চলচ্চিত্রটির মুক্তি দিন ধার্য করা হয় ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে। পরে তা পরিবর্তন করে ২১ ডিসেম্বর ৫০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২৮ ডিসেম্বর ছবিটি সীমিত পরিসরে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে ২০১৩ সালের ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের বেভারলি হিলসের উইলশায়ার প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়।
যারা মেলে ধরেছেন কাহিনী
বেশ কজন জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীর দেখা মিলেছে এই চলচ্চিত্রে। আর তাদের অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছে ‘পিতা’। পরিচালক মাসুদ আখন্দকে এ সিনেমায় পাওয়া যায় জলিল চরিত্রে। এতে একজন বিপত্নীক কামার তিনি। যিনি তার মেয়েকে বাঁচাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন বিপিন চরিত্রে। কল্যাণ কোরাইয়া অভিনয় করেন শরৎ চরিত্রে। আর তার বিপরীতে শায়না আমিন অভিনয় করেন পল্লবী চরিত্রে। শরতের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন তিনি। রফিকুল ইসলাম অভিনয় করেন বিশু চরিত্রে। জলিলের আশ্রয়দাতা ছিলেন তিনি। জলিলের স্ত্রী কুসুমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা মির্জা। মারিয়া ফারাহ উপমাকে পাওয়া যায় শর্মিলী নামের একটি চরিত্রে। মঈন দুররানী অভিনয় করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার চরিত্রে। শামীমা নাজনীন চরিত্রে কমলা পিসি, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ও শর্মিলীর বাবা নিতাই চরিত্রে অভিনয় করেন আজিজুর রহমান আখন্দ। শর্মিলীর মায়ের চরিত্রে ছিলেন আর্জুমান্দ আরা বেগম। একজন ফকিরের চরিত্রে পাওয়া যায় এহসানুর রহমানকে এবং জলিলের মেয়ে লীলা চরিত্রে অভিনয় করেন অরা তাবাসসুম।
শুটিং ফ্লোরে
‘পিতা’ চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হয় ২০১১ সালের ৬ জুন গাজীপুরের সরকারপাড়ায়। সেখানে প্রথম ধাপে ১৫ দিন ও দ্বিতীয় ধাপে ১০ দিন শুটিং হয়। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন সাইফুল শাহীন ও সম্পাদক ছিলেন মাসুদ আখন্দ। পরিবেশক ছিল ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।
সিনেমার গান
‘পিতা’ চলচ্চিত্রের গানের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। শীর্ষ সঙ্গীতের সুর করেছেন এরশাদ ওয়াহিদ। গানের কথা লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ, মাসুদ আখন্দ ও শায়ান ওয়াহিদ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিশু শিকদারের গান ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন পান্থ কানাই, চঞ্চল চৌধুরী, দিলশাদ নাহার কনা, মেহের আফরোজ শাওন, পলাশ ও সায়ান ওয়াহিদ। হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রের বাইরে এই প্রথম নেপথ্য গানে কণ্ঠ দেন শাওন। সিনেমাটির গানগুলোর শিরোনাম ‘তোর ভিতরে আমি থাকি’। মাসুদ আখন্দর লেখা গানটি গেয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন। ‘আমি যাইনি কখনো আমার পিতার গ্রামে’ গানটি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন।
একটি গানের গল্প
গানের মধ্যে যারা খুঁজে ফেরেন ব্যতিক্রম, তাদের কাছে সুপরিচিত শিল্পী সায়ান। ব্যতিক্রমী কথা আর হৃদয়ছোঁয়া সুরই তার গানকে করে তুলেছে সুপরিচিত। গানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, অন্ধকারের বিপরীতে আলোর দিশা অনুসন্ধান করে চলেন তিনি। এই শিল্পীর চলচ্চিত্রের গানে অভিষেক হয় ‘পিতা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। মাসুদ আখন্দ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ছবি ‘পিতা’র শীর্ষ সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন তিনি। যত দূরে যাও, পেছনে তাকাও/ শুধু পরাজয়, তারই দেখা তুমি পাবে/ শীর্ষক গানটিতে সায়ানের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠ দেন উদীয়মান শিল্পী ও সুরকার এরশাদ। গানটির কথা লিখেছেন সায়ান নিজেই আর সুর করেছেন এরশাদ। প্রথম চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাকে কণ্ঠ দেওয়া প্রসঙ্গে সায়ান বলেন, “একটা সময় বাংলাদেশের ছবিতে অনেক সুন্দর সুন্দর গান থাকতো। সেইসব গান শুনতে এখনও ভালো লাগে। গান গেয়ে মোটামুটি পরিচতি পাওয়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাকে কণ্ঠ দিচ্ছি না। আসল কথা হলো সেরকম গল্প আর গানের ছবি পাইনি বলেই কণ্ঠ দেওয়া হয়নি। ‘পিতা’ ছবির গল্পটি যেমন আমার ভালো লেগেছে, গানটিও অসাধারণ। সব মিলিয়ে মনে হলো এ ছবির এ গানটিতে আমি কণ্ঠ দিতে পারি। এ গানটির মাধ্যমে প্লেব্যাকে আমার অভিষেক হলো। সায়ান আরও বললেন, ‘পিতা’ ছবিটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ছবি। তাই এ ছবির গানে কণ্ঠ দিয়ে আলাদা আবেগ অনুভব করেছি।”
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
চলচ্চিত্রটিতে কাজ করে ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ সুরকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ইমন সাহা। এ ছাড়া সিনেমাটির জন্য ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন মাসুদ আখন্দ।
যা আছে সিনেমায়
এই সিনেমার কাহিনী ছিল আর দশটি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার ব্যতিক্রম। এখানে দেখা যায়, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যেকোনো সময় গ্রামে আসতে পারে এমন খবরে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান নিতাই সভা ডেকেছেন। গ্রামের একমাত্র মুসলমান কামার জলিল তার আশ্রয়দাতা পিতা বিশুকে এই বলে বাড়ি থেকে বের হন। আবার জমাদার সাহেবের বাড়িতেও সভা হচ্ছে। তিনি চান না পাকিস্তান আলাদা হোক। বিপিন কিছুটা উদ্বিগ্ন এবং তিনি চাচ্ছেন দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তার পুত্র শরৎ এতে রাজি নন। তিনি দেশের হয়ে লড়তে চান। এছাড়া তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া যাবে না। শর্মিলী নিতাইয়ের মেয়ে। কিছুদিন আগে বিধবা হয়েছেন। তিনি জলিলের মেয়েকে স্নেহ করেন এবং জলিলের সংসারের প্রতি তার খুব মমতা। একদিন এক বুনো শূকর গ্রামে ঢুকে পড়ে। সকলেই তাকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে। রাতে শরতের স্ত্রী পল্লবীর প্রসবের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি ধাত্রী কমলা মাসিকে নিয়ে আসেন। এসময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীরাও গ্রামে হানা দেয়। শরৎ তার বাবা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে পালান। কিন্তু ধাত্রীর ব্যাগ আনতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে। তার বাবা তাকে বাঁচাতে ছুটে যান এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুজনকেই হত্যা করে। তাদের মতো আরও অনেকেই তাদের হাতে মারা যান। জলিল তার ছেলেদের নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও মিলিটারি তার মেয়ে, শর্মিলীসহ আরও কয়েকটি মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। জলিল মেয়েকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন।
চলচ্চিত্রটি নিয়ে মাসুদ আখন্দ
মাসুদ আখন্দ জানান, ‘পিতা’ আমার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। আমি সুইডিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে ফিল্ম ডিরেকশনের উপর গ্রাজুয়েশন করেছি। আমার স্ক্রিপ্ট লেখা শেখা শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কাছে। এই চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখি ২০১০ সালে। আমি সৌভাগ্যবান যে, স্যার আমার স্ক্রিপ্ট পড়েছেন এবং কিছু জায়গায় সংশোধন করে দিয়েছেন। স্যার যখন প্রথমবার আমেরিকায় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য যান সেদিনই আমি চলচ্চিত্রটি শুটিং শুরু করি। স্যার বিদেশ যাবার পরও আমার চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের খোঁজখবর নিয়মিত রাখতেন। প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত হবার কারণ হচ্ছে আমার বাবা ’৭১ সালে পাকিস্তানের সৈনিক ছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন দেশে পালিয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু দেশে আসার পর পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। এরপর দীর্ঘ চার বছর পাকিস্তানে জেল খেটেছেন। সেই চার বছর তার উপর প্রচুর অত্যাচার করা হয়েছে। এরপর বাবা পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হবার পর দেশে আসেন। দেশে আসার পর কিছুদিন থেকে সুইডেন চলে যান। আমার বাবা ২০১০ সালে মারা যান। বাবা মারা যাবার পর আমি মুক্তিযুদ্ধের উপর স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করি। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী হই। আমার ফিল্মের পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ সুইডেন থেকে করে এনেছি। চলচ্চিত্রটিতে ডিরেকশন, অভিনয় করা, গান লেখাসহ মোট ১১টি ক্ষেত্রে নিজের কাজের ছাপ রাখার চেষ্টা করেছি। আমি আশা করি ‘পিতা’ চলচ্চিত্রটি দেখে দর্শকের চোখে জল আসবে।
শেষ কথা
সত্যি সত্যিই ‘পিতা’ চলচ্চিত্রটি দেখে কেঁদেছেন অনেক দর্শক। সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই কাহিনীর রেশ থেকে যায় মনের গভীরে। এখনও যারা সিনেমাটি দেখেননি তার দেখে নিতে পারেন। ইউটিউব থেকে ঘরে বসেই দেখতে পারেন এটি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্দের সিনেমা