পুড়ে যাওয়া ক্ষত থেকে জ্বলে ওঠা আইভি

ঋষিকা

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি পেশায় একজন মানবাধিকারকর্মী। তিনি কাজ করছেন পুড়ে যাওয়া মানুষদের অধিকার বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে। জান্নাতুল পুড়ে যাওয়া মানুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। ২০২৩ সালে বিবিসি’র ১০০ নারীর তালিকায় একমাত্র যে বাঙালির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি জান্নাতুল আইভি। জান্নাতুল একজন লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সার্বক্ষণিক মানবাধিকার কর্মী। জান্নাতুল কাজ করেন অধিকার সচেতন করে তুলতে। তার সংগঠনের নাম ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’। যে মানুষটা নিজেই একটা সময় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি কাজ করছেন অধিকার নিয়ে। আগুনের লেলিহান শিখা তার জীবন কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে দিলেও থামিয়ে দিতে পারেনি তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে।

ছোট আইভির স্বপ্ন

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভির জন্ম খুলনার খালিশপুরে। আইভি একাধারে একজন মানবাধিকার কর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। তবে জান্নাতুল কি হতে চেয়েছিলেন ছোটবেলায়? আইভি জানান, তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন আর্কিটেক্ট। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো নম্বর না পাওয়ায় সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। অন্য কোথাও পড়া হয়নি কারণ তিনি চেয়েছিলেন বুয়েটে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়তে। সেটাই যখন হয়নি তখন আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়েছেন। তবে আইভির ড্রয়িংরুমে বুয়েটের একটা ক্রেস্ট চোখে পড়ে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুয়েটের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের নারীদের গ্রুপ আমাকে একবার সম্মানিত করেছিলেন। নারীদের অধিকার নিয়ে তৈরি একটি শর্টফিল্মের জন্য তাকে সম্মানিত করা হয়। যেই বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ হয়নি সেখান থেকে নিজের কাজের জন্য এমন একটি সম্মাননা তাকে অনুপ্রেরণা দেয়।

ভয়াবহ সেই দিনটি

১৯৯৭ সালে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে রান্নাঘরে ওড়নায় আগুন লেগে পুরো শরীর পুড়ে যায় আইভির। সঙ্গে সঙ্গে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা জানান, তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এতোটা পুড়ে যাওয়া রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা একদমই কম। তবুও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সারিয়ে তুলতে থাকেন আইভিকে। ৫২ দিন হাসপাতালে থেকে মানসিক ও শারীরিক কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। এরপর থেকে শুরু হয় অন্য এক লড়াই। আইভি বলেন, ‘এমনও বলতে শুনেছি, এতো পুড়ে গেছে! তার ওপরে তো মেয়ে, ওকে মেরে ফেল! ওর বেঁচে থেকে কি লাভ! আবার মসজিদে আমার সুস্থতার জন্য দোয়া হতেও দেখেছি।’

কটূ কথার পাশাপাশি সহযোগিতাও পেয়েছেন জান্নাতুল। পেয়েছেন মানসিক শক্তি। নিজের মধ্যবিত্ত পরিবারকে দেখেছেন তার চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে। কখনো তার মামা রাতের পর রাত থেকেছেন হাসপাতালে, কখনো নানা বিক্রি করে দিতে চেয়েছেন তার শেষ সম্বল বাড়িটা। যেই বাবা-মা’কে কখনো ঝগড়া করতে দেখেননি, সেই বাবা-মা’কে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে দেখেছেন। জান্নাতুল বলেন, ‘আমি বুঝতাম বাবা টাকা জোগাড় করতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন, তার কষ্ট হতো। সেই চাপ থেকেই রেগে যেতেন, কিন্তু কোনোদিন আমাকে বুঝতে দেননি যে তাদের কষ্ট হচ্ছে বা আমি তার কাছে একটা বোঝা।’ নিজের সেই পরিস্থিতিতে পরিবারকে পুরোপুরিভাবে পাশে পেয়েছেন জান্নাতুল। বাবা, মা, ভাই বোন সবাই তাকে সাহায্য করেছেন সবক্ষেত্রে। যা করতে চেয়েছেন, সাহায্য পেয়েছেন তাদের কাছে, উৎসাহ পেয়েছেন।

আবারও লেখাপড়ায় ফেরা

দুর্ঘটনার কারণে লেখাপড়া একটা সময় বন্ধ রাখতে হয়েছিল আইভিকে। বিএল কলেজ থেকে পড়া শেষ করতে পারেননি তিনি। এদিকে মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর আবারও লেখাপড়া শুরু করার ইচ্ছা হয় আর। পরে ২০০৫ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন আইভি। ২০০৯ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন শিক্ষায় এমএস করেছেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এলএলবি এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে ২০১২ সালে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট, নিউওয়েভ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ও ডেইলি স্টার আয়োজিত বিভিন্ন অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স বিষয়ে পড়াশোনাও করেছেন আইভি। আইন আর ফিল্ম মেকিং নিয়েও পড়ালেখা করেন তিনি। অধিকার সম্পর্কে জানতে গেলে তাকে জানতে হবে অনেক কিছু। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আইনের সাহায্য নেওয়ার জন্য বুঝতে হবে আইন। আর সে জন্যই আইন নিয়ে লেখাপড়া শেষ করেছেন তিনি। আর ডিজেবল মানুষদের অধিকার সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরার জন্য শিখেছেন পর্দার পেছনের কাজ। নিজের প্রথম স্ক্রিনের কাজে নিজেই অভিনয় করেছেন আইভি।

সেলুলয়েড আর সাহিত্যে

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘উত্তরণ’, ‘নীরবে’ এবং ‘খিজিরপুরের মেসি’। আইভির লেখালিখি শুরু ২০০১ সাল থেকে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উপন্যাস ‘স্বপ্ন নির্মাণ প্রয়াস’ (ইংরেজি অনুবাদসহ), ‘পোড়া মাটির রাজকন্যা’ (ইংরেজি অনুবাদসহ); স্মৃতিকথা ‘আহমদ ছফার অপরাহ্নের সূর্য’ ও ‘সময়ের প্রতিচ্ছবি’। ‘সময়ের প্রতিচ্ছবি’ বইটি আইভির প্রথম প্রবন্ধ সংকলন। উপন্যাস লেখার ইচ্ছা থেকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় যখন তার মনকে নাড়া দেয় সেই বিষয়গুলোই কবিতার লাইনে পরিণত হয়। ‘মানবী’ আইভির প্রকাশিত প্রথম কবিতা সংকলন।

ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

খুলনায় বড় হওয়া জান্নাতুল ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা বিএল কলেজে। তবে তার বাবার চাকরির কারণে ১৯৯৪ সালের দিকেই তাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে। অনার্স পড়তে আবার খুলনা বিএল কলেজে ভর্তি হন জান্নাতুল। সেখানে পড়াকালীন এক ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এসে তার জীবনে ঘটে যায় সেই দুর্ঘটনাটি। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জান্নাতুল। আর এর সমস্ত কৃতিত্ব তিনি দিতে চান তার পরিবারকে। তবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেক সময় লেগেছিল তার। প্লাস্টিক সার্জারি করাতে পঞ্চাশবারেরও বেশি বার যেতে হয়েছিল ডাক্তারদের ছুরি-কাঁচির নিচে। চিকিৎসা নিচ্ছেন এখনো। সার্জারি আর শুরুর দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে জান্নাতুল বলেন, এমন কথাও শুনতে হয়েছে বাংলাদেশে তো নারী প্লাস্টিক সার্জন নেই, তুমি তাহলে পুরুষ সার্জনদের কাছেই চিকিৎসা নেও? লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। চিকিৎসা করে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার শুরু করেন লেখাপড়া। বোনের মাধ্যমে পরিচিতদের টিউশনি করাতে শুরু করেন। সেটাও কোনো সহজ কাজ ছিল না। কারণ তার পোড়া ক্ষতর কারণে অনেকেই তাকে তখনও মেনে নিতে পারতেন না। এক সময় কাজ শুরু করেন এনজিওতে। কাজ করতে যেয়ে বুঝতে পারেন অসমতার সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু জান্নাতুলের অধিকারের আদায়ের লড়াই।

আইভির ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ

২০১৫ সাল থেকে পথচলা শুরু তার ভয়েস অ্যান্ড ভিউ এনজিওটির। ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ এই পর্যন্ত কাজ করেছে তিনটি জেলায়। আইভি বলেন, ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ নিয়ে আমরা তিনটি জেলায় ক্যাম্পেইন করতে পেরেছি। আমি চাই এই সচেতনতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে।’ পুড়ে গিয়ে বেঁচে ফিরে আসা মানুষগুলোর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হলে নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। সেই লক্ষ্যে তার এনজিও কাজ করে যাচ্ছে দিন-রাত। কাজ করে যাচ্ছে ওই মানুষগুলোকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে।

মিস করেন বাবাকে

ঘরের বুক সেল্ফের ওপরে সাদা কালো ছবির মতো এখন অতীত হয়ে গেছেন আইভির বাবা। মধ্যবাড্ডার বাড়িতে আইভি থাকেন মা’কে নিয়ে। তার ছোট ভাইও একই এলাকাতে থাকেন। বাবাকে মিস করেন কি না জানতে চাইলে আইভি বলেন, ‘হ্যাঁ, বাবাকে অনেক মিস করি। আমার স্ট্রাগল টাইমে বাবাসহ পুরো পরিবার আমার পাশে ছিল। এখন যখন ভালো কিছু হচ্ছে আমি বাবাকে অবশ্যই মিস করি। কারণ বাবা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন আর অনুপ্রেরণা দিতেন।’ আইভি জানান, তার বাবা তাকে ডাকতেন ‘আব্বুজি’ বলে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 5 =