প্রতিদিন ‘পথ খাবার’ খাচ্ছেন ৬০ লাখ মানুষ

গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডে ফুচকার দোকানে তার সঙ্গে কথা হয়। বলছিলেন, অস্বাস্থ্যকর বা রোগজীবাণু নিয়ে অতশত ভাবেন না। বেইলি রোডের ফুচকা খেতে ভালোই লাগে, তাই স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছেন। এভাবে রাজধানীর অনেকে যেমন সখ করে ফুটপাথের বা ‘পথ-খাবার’ খেয়ে থাকেন, তেমনি বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিতান্ত প্রয়োজনেই এই পথের খাবার খেতে হয়। বিশেষ করে অফিস-আদালতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মানুষদের মধ্যাহ্নভোজের ভরসা এই পথ খাবার।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন ৬০ লাখ মানুষ ঢাকায় পথ খাবার খেয়ে থাকেন।

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র- আইসিডিডিআর,বির গবেষকরা বিক্রেতার কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে দেখেছেন অধিকাংশ খাবারে প্রচুর জীবাণু রয়েছে। এর প্রধান কারণ বিক্রেতাদের অসচেতনতা। পথখাবার যারা বিক্রি করেন তাদের বসার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নাই। তারা ফুটপাথেই বসছেন। ফলে ধুলোবালি, রোগ-জীবাণু সহজেই মিশে যাচ্ছে। পাশাপাশি হাত পরিষ্কার না করেই তারা খাবার তৈরি করছেন।

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় এসেছে, ফুটপাথের ৫৫ ভাগ খাবারেই জীবাণু রয়েছে। আর ৮৮ ভাগ বিক্রেতার হাতেই জীবাণু থাকে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পথ-খাবার নিয়ে গবেষণা করে। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে দৈনিক রাজধানীর ৬০ লাখ মানুষের পথ-খাবার খাওয়ার তথ্য। ফুটপাথের খাবার বিক্রেতাদের খাবারের স্বাস্থ্যগত মান ঠিক রাখতে সরকার একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। তখন জাতীয় গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ১০০ খাবার বিক্রেতাকে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফুটপাথের সব বিক্রিতাকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও সবাইকে তা দেওয়া হয়নি।

ঢাকায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক কার্যক্রমের আওতায় করা ওই বছরেরই এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকাতে ৮ হাজার বা তারও বেশি ফুটপাতের খাবার বিক্রেতা রয়েছেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭ হাজার ৭৫৪ জন পথ-খাবার বিক্রেতার ওপর জরিপ করা হয়। তাদের বিক্রি করা খাবার পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়।

আইসিডিডিআরবি ওই খাবার নিয়েই গবেষণা করে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকার ৫৫ শতাংশ পথ-খাবারে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। এসব খাবার বিক্রেতার ৮৮ শতাংশের হাতে জীবাণু থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বীথি ইত্তেফাককে বলেন, ‘পথ-খাবারে কিন্তু একটা বড় অর্থনীতি রয়েছে। ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের মাধ্যমে এই লেনদেনটাও হলেও একসঙ্গে করলে এটার পরিমাণ বিশাল। সরকারের উচিত্ বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে নিরাপদ খাদ্য জোন করা। এটা করা গেলেও সরকার কিছুটা হলেও ট্যাক্স পেত। এখন এই খাবারের মান নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু ঈদের সময় ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালালেও সারা বছর এটা দেখভালের কেউ নেই। এটা দেখার ব্যবস্থা করতে হবে।’

মতিঝিল এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আব্দুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অফিসে থাকার কারণে দুপুরে বাসায় গিয়ে খাবার খাওয়ার সুযোগ নেই। অফিসেও খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই ফুটপাথের খাবারেই আমাদের ভরসা রাখতে হয়। সবাই যে অস্বাস্থ্যকর তা কিন্তু নয়, অনেকের খাবারই স্বাস্থ্যকর। তারা অনেক যত্ন করে খাবার তৈরী করেন। অনেকে বাসা থেকে রান্না করে এসে ফুটপাথে বিক্রি করেন।’

দেশের একমাত্র খাদ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার ৪৬টি স্কুলের সামনে থেকে ঝালমুড়ি, ফুচকা ও আচারের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোতে কৃত্রিম রঙ, ইস্ট, কলিফর্ম, মাইকোটক্সিন, সিসার মতো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, খোলা খাবারের জীবাণু দ্বারা খুব সহজেই শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। সংগ্রহ করা খাবারে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম এবং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

মিরপুর গোলচত্বরের পাশেই ভাত-পরোটার দোকান চালান রফিকুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত তিনশ’ মানুষের খাবার তিনি তৈরি করেন। দুপুরে মধ্যবিত্ত কর্মজীবীরা তার দোকানে ভাত খান। পাশের স্কুল থেকেও শিশুরা এসে পরোটা কিনে নিয়ে যায়।’

হোটেলটির মালিক বলেন, ‘যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি। ফিল্টার পানিও আছে আমাদের।’ অন্যদিকে আরেকদল শখের কারণে প্রতিনিয়ত খাচ্ছেন পথের খাবার। রাস্তার পাশে শীতের বিভিন্ন পিঠা থেকে শুরু করে চটপটি, ফুচকার জনপ্রিয়তা তারই প্রমাণ দেয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − five =