প্রিয়দর্শিনীর ৫০

মৌ সন্ধ্যা

অনেক অর্জন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঢালিউডের প্রিয়দর্শিনী নায়িকা মৌসুমী। তিনি শুধু নন্দিত নায়িকাই নন, ঢাকাই সিনেমার এক উজ্জ্বল ইতিহাসও। বাংলা সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গেলেই সামনে এসে পড়বে তার নাম। যাদের হাত ধরে ঢালিউডের সোনালি দিন এসেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। ৩ নভেম্বর প্রিয়দর্শিনী মৌসুমীর জন্মদিন। পঞ্চাশে পা রাখলেন সবার প্রিয় নায়িকা। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

খুলনা জেলার সেই মেয়েটি

১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন মৌসুমী। তার বাবার নাম নাজমুজ্জামান মনি এবং মায়ের নাম শামীমা আখতার জামান। মৌসুমীর ছোটবেলা কেটেছে খুলনাতেই। ছোটবেলা থেকেই অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। গানও গাইতেন। এরপর তিনি ‘আনন্দ বিচিত্রা ফটো বিউটি কনটেস্ট’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। পরে তিনি ১৯৯০ সালে টেলিভিশনের বাণিজ্যিক ধারার বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হন। এরপর এক চমক এসে যায় জীবনে। খুলনা জেলার আরিফা পারভিন জামান নামের সেই মেয়েটি হয়ে যান ঢাকায় সিনেমার জনপ্রিয় মুখ মৌসুমী।

প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত

সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা দিয়ে ঢালিউডে অভিষেক হয় মৌসুমীর। তার নায়ক ছিলেন সালমান শাহ। এক সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন সালমান-মৌসুমী। এক সাক্ষাৎকারে এই সিনেমায় প্রথম দিন অভিনয় নিয়ে মৌসুমী বলেন, ‘প্রথম দিন ক্যামেরার সামনে ভয়ে কাঁপছিলাম। একটি দৃশ্য ছিল, ওই দিন একটা বাইকে সালমান আর আমি এফডিসি থেকে কাঁচপুরে গেছি। আবার ফিরে আসি। কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিতে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ছিল ওটা।’

মৌসুমীর যতো আলোচিত সিনেমা

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এ অভিনেত্রীকে। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত মৌসুমী ছিলেন চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়িকা। প্রথম সিনেমার পর মৌসুমী অভিনয় করেন ওমর সানির বিপরীতে ‘দোলা’ সিনেমায়। তার অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা পায়। পরের বছর সালমান শাহের বিপরীতে গীতিকার ও পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত ‘স্নেহ’, শিবলি সাদিক পরিচালিত ‘অন্তরে অন্তরে’ ও শফি বিক্রমপুরির ‘দেনমোহর’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে মৌসুমী অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র শহীদুল ইসলাম খোকনের সাইকো-থ্রিলার ‘বিশ্বপ্রেমিক’। ১৯৯৬ সালে নিজের প্রযোজিত ‘গরীবের রানী’ ও ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া চিত্রনায়ক মান্না প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘লুটতরাজ’-এ অভিনয় করেন। ১৯৯৯ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ ও মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘মগের মুল্লুক’ সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনেমা দুটি ব্যবসাসফল হয়। এরপর ‘পরাধীন’, ‘রক্তের অধিকার’, ‘বউয়ের সম্মান’, ‘সুখের আশায়’ চলচ্চিত্রেও দর্শক মাতান মৌসুমী। ২০০১ সালে নার্গিস আক্তার পরিচালিত ‘মেঘলা আকাশ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরের বছর কাজী হায়াতের ‘ইতিহাস’ ও এফ আই মানিক পরিচালিত ‘লাল দরিয়া’ ছায়াছবি বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করে। ২০০৩ সালে তার নিজের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ও দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ‘বীর সৈনিক’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। ২০০৪ সালে ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নতুনভাবে আবারো ফিরে পান শীর্ষ নায়িকার আসন। পরবর্তী দুই বছর মৌসুমীই ছিলেন শীর্ষ চলচিত্র অভিনেত্রী।

২০০৪ সালে তার অভিনীত ‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। পরের বছর ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে নির্মিত ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ ও তার নিজের পরিচালিত ‘মেহের নিগার’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। ২০০৮ সালে ‘একজন সঙ্গে ছিল’ ছায়াছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন পরিচালিত ‘বাবা আমার বাবা’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। ২০১০ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন বিলাতে’ সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন।

২০১১ সালে মুক্তি পায় মৌসুমী অভিনীত মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত ‘কুসুম কুসুম প্রেম’, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘প্রজাপতি’ ও চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দুই পুরুষ’। ২০১৩ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস দেবদাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত দেবদাস চলচ্চিত্রে ‘চন্দ্রমুখী’ চরিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর মোস্তাফিজুর রহমান মানিক পরিচালিত ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৪ সালে মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘তারকাঁটা’ সিনেমায় আরিফিন শুভর বোনের চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ প্রযোজিত ‘এক কাপ চা’ ছায়াছবিতে একজন লাইব্রেরিয়ান চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৫ সালে ঈদে মুক্তি পায় ইন্দো-বাংলা প্রযোজনায় ‘আশোক পাতি’ ও আব্দুল আজিজ পরিচালিত ‘আশিকী’। ২০১৬ সালের ভালোবাসা দিবসে মুক্তি পায় মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত ‘মন জানে না মনের ঠিকানা’। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন আইনজীবীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে মুক্তি পায় ‘রাত্রির যাত্রী’। এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী, আনিসুর রহমান মিলন।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

একজীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন মৌসুমী। কোটি মানুষের ভালোবাসা তার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। মৌসুমী ‘মেঘলা আকাশ’ সিনেমার জন্য ২০০১ সালে প্রথম এই পুরস্কার হাতে পান। এরপর ২০১৩ সালে ‘দেবদাস’ ও ২০১৪ সালে ‘তারকাঁটা’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ৬ বার, পেয়েছেন মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন আরও অনেক পুরস্কার।

পরিচালক ও প্রযোজক মৌসুমী

অভিনয়জীবনের তিনি দশক পূর্ণ করেছেন মৌসুমী। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালকের খাতায়ও লিখিয়েছেন নাম। ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ দিয়ে মৌসুমী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে পরিচালনা করেন ‘মেহের নিগার’। ২০১৬ সালে ‘শূন্য হৃদয়’ নামে একটি টেলিফিল্ম পরিচালনা করেন। মৌসুমী ১৯৯৬ সালে ‘গরিবের রানী’ সিনেমা দিয়ে প্রযোজকের খাতায় নাম লেখান। তিনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কপোতাক্ষ চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে মুশফিকুর রহমান গুলজারের পরিচালনায় ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’ ও মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালনায় ‘বউয়ের সম্মান’ সিনেমা প্রযোজনা করেন। এরপর দীর্ঘ ১৯ বছর পর তিনি আবার ‘আমি এতিম হতে চাই’ এর মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় ফিরেন। চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে মৌসুমী ও ঋদ্দি টকিজ।

ছোটপর্দায় মৌসুমী

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন। সেই সঙ্গে নাম লিখিয়েছেন উপস্থাপনায়ও। ২০১৬ সালে চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টুর নির্দেশনায় ‘মেঘের আড়ালে’ টেলিফিল্মে অভিনয় করেন। এতে প্রথমবারের মতো একসাথে টেলিফিল্মে অভিনয় করেন মৌসুমী ও রিয়াজ। একই বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে আফতাব বিন তমিজের নির্দেশনায় ‘অতীত হারায়ে খুঁজি’ টেলিফিল্মে কাজ করেন। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ওমর সানি। এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই টেলিভিশন নাটকে দেখা যায় মৌসুমীকে। ‘ভালোবাসার ২০ বছর’ নামের একটি টেলিছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন মৌসুমী ও ওমর সানী।

গায়িকা মৌসুমী

মৌসুমী ২০০৪ সালে জাহিদ হোসেন পরিচালিত ‘মাতৃত্ব’ সিনেমায় একটি গানে কণ্ঠ দেন। ২০০৭ সালে ইথুন বাবুর সুরে ২০১৪ সালে মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত তারকাঁটা সিনেমায় ‘কি যে শূন্য লাগে তুমিহীনা’ গানে কণ্ঠ দেন। এছাড়া মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘ছায়াছবি’ চলচ্চিত্রে ‘মন যা বলে বলুক’ গানের গীত রচনা করেছেন মৌসুমী।

মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন

মৌসুমী গড়ে তুলেছেন ‘মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অসহায় মানুষের জন্য কাজ করেন এ ফাউন্ডেশনের ব্যানারে। অভিনেত্রী মৌসুমী ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মৌসুমী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার ফাউন্ডেশন। ব্যক্তি মৌসুমী ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একজন উদারমনা ও মানবসেবী তারকা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। সে ধারাবাহিকতা বজায় আছে এখনও। সাথে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক মৌসুমীর বিভিন্ন ফ্যান ক্লাব।

শুভেচ্ছা দূত মৌসুমী

২০১৩ সালে জাতিসংঘের শিশু তহবিল সংস্থা ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত মনোনীত হন চিত্রনায়িকা আরিফা জামান মৌসুমী। শিশু, নারী, মানবতা ও সর্বোপরি বিশ্ববাসীর কল্যাণে জাতিসংঘের কাজে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে ইচ্ছুক খ্যাতিমান তারকাদের শুভেচ্ছা দূত মনোনীত করে থাকে ইউনিসেফ। মৌসুমী বলেন, ‘আমার বাবার অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেই জায়গা থেকেই আমার এখানে আসা। সমাজের একজন জনপ্রিয় মানুষ হিসেবে তাদের জন্য কিছু করা আমার দায়িত্ব’। এছাড়া আরও নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন মৌসুমী।

মৌসুমীর পরিবার

মৌসুমী ১৯৯৬ সালের ২ আগস্ট জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ওমর সানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুখী ও স্টাইলিশ তারকা দম্পতি বলা হয় তাদের। দাম্পত্য জীবনে তাদের ফারদিন এহসান স্বাধীন (ছেলে) এবং ফাইজা (মেয়ে) নামের ২টি সন্তান রয়েছে।

শেষ কথা

সংসার, অভিনয়, নানা সামাজিক কাজ নিয়ে বেশ সময় কাটাচ্ছেন মৌসুমী। সুন্দর কাটুক তার আগামীর দিনগুলো। শুভ জন্মদিন প্রিয়দর্শনী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × three =