প্রীতম-শেহতাজ: ‘যাদুকর’র ছোঁয়ায় কাছে এসেছিলেন

সংশপ্তক হাসান

এই সময়ের আলোচিত দম্পতি হিসেবে পরিচিত প্রীতম ও শেহতাজের। এক যাদুকরের ছোঁয়ায় মডেল ও অভিনেত্রী মনিরা হাশেম শেহতাজের প্রেমে পড়েছিলেন সংগীত পরিচালক ও গায়ক প্রীতম হাসান। তবে এই যাদুকর কোনো ব্যক্তি নয়, এটি একটি গান। প্রীতম তার ‘যাদুকর’ শিরেনামের গানটিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন শেহতাজে। ঘটনাটি ২০১৭ সালের।

সেসময় যাদুকর গানটি তৈরি করেছেন প্রীতম। এর মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসেবে ছিলেন শেহতাজ। সেখানে তাকে প্রীতমের বিপরীতে দেখা গিয়েছিল। ওই মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করতে গিয়েই শেহতাজের সঙ্গে প্রীতমের সম্পর্কের শুরু। পর্দার মতো বাস্তবেও জুটি বাধার স্বপ্ন দেখেন তিনি। যদিও স্বপ্নটি পূরণ করতে লম্বা সময় লেগেছে প্রীতমের। তবে স্বপ্নের কথা শেহতাজকে জানাতে মোটেও সময় নেননি তিনি। সাহস নিয়ে সরল বিশ্বাসে মনের কথা জানিয়েছিলেন তাকে।

প্রীতম যখন শেহতাজকে প্রেমের কথা জানান তখন প্রায় শূন্য হাতে তিনি। জাদুকর নামে যে গানটি করে শেহতাজের মায়ায় পড়েছিলেন সে গান শ্রেতাপ্রিয় হলেও ভিউয়ের মানদণ্ডে তা ছিল একেবারে কম। ওদিকে পকেটে মাত্র ৭০০ টাকা। তবে হৃদয়ে ভালোবাসার প্রাচুর্য ছিল। সেই জোরেই শেহতাজকে প্রেমের প্রস্তাব দেন তিনি। তাকে তিনি বলেন, শেহতাজ তোমাকে এখন দেওয়ার মতো কিছু নাই, পকেটে আছে আজকে শুধু ৭০০ টাকা। তাই আপাতত তোমাকে মন ছাড়া কিছু দিতে পারব না। প্রীতমের মুখ থেকেই না হয় শোনা যাক সে গল্প। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে প্রীতম বলেছিলেন, ওই যে আমার একটা গান আছে না ‘মন নিয়ে আমি তো করি না খেলা’ বাস্তবেও আমি তেমন। তাই এই জায়গার সব মেয়েদের বলছি, কোনো ছেলে যদি পকেটে ৭০০ টাকা নিয়ে তোমার সঙ্গে ডেটে যেতে চায় তাহলে বুঝে নিও সে নিজের আরও অনেক শখ বাদ দিয়ে তোমার সঙ্গে ডেটে যাচ্ছে, তাকে ফিরিয়ে দিও না। আর শেহতাজকে অনেকেই তেমন জানে কারণ সে পাবলিকলি তেমন কথা বলে না। সে এত অনেস্ট একটা মেয়ে বলে বোঝানো যাবে না, শেহতাজ আশেপাশে থাকলে আমি অন্য দুনিয়ায় থাকি।

বোঝাই যাচ্ছে প্রেম ও প্রিয়তমা নিয়ে প্রীতমের অনুভুতিটা অন্য মাত্রার। এই গভীর অনুভূতিই গায়ককে দিয়েছিল সাহস। শেহতাজকে নিজের জীবনের সঙ্গে বাঁধার তাড়নায় তার মায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রীতম। সরাসরি জানিয়েছিলেন শেহতাজের প্রতি নিজের অনুভুতির কথা। কিন্তু ওই যে মায়েরা তো আবেগের চেয়ে পোড় খাওয়া বাস্তবতার সাথে বেশি পরিচিত। শেহতাজের মা-ও তাই। তিনি প্রীতমকে এক গাদা শর্ত দিয়ে জানিয়েছিলেন, এগুলো পূরণ করতে পারলেই তার কন্যাকে তার হাতে তুলে দেবেন তিনি।

শর্তগুলো কী সে সম্পর্কে বিস্তারিত কখনও বলেননি প্রীতম। তবে আন্দাজ করা যায়, হয়তো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শর্ত দিয়েছিলেন মেয়ের প্রণয় প্রত্যাশীকে। প্রীতমও নেমে পড়েন সেসব শর্ত পূরণে। শুরু হয় নতুন তপস্যা। শেহতাজের মাকে প্রসন্ন করে নিজের পছন্দের মানুষকে জয় করার সাধনা। এই সাধনায় সাফল্য অর্জন করতে প্রীতমের লেগে যায় পাঁচ বছর। অতঃপর শেহতাজের মায়ের দেওয়া শর্ত পূরণ হয়। তাই প্রীতমও আর দেরি না করে প্রিয়তমাকে পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

আর ওদিকে শেহতাজ? তাকে তো কবেই মুগ্ধ করেছিল প্রীতমের সারল্য। চলুন তার মুখ থেকেই শুনি। এক সাক্ষাৎকারে শেহতাজ বলেন, ‘প্রীতম ভীষণ মেধাবী, ভদ্র। তার সততা, সরলতা আমাকে বেশ আকর্ষণ করে।’ শেহতাজ প্রীতমের কথা শুনে বোঝাই যায় দু’টি মন আর দু’জনাতে ছিল না। মিশে গিয়েছিল এক মোহনায়। ফলে পাঁচ বছরের অপেক্ষা ও শর্তের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মিলন হয় তাদের। তবে মেয়ের নতুন জীবনে পা রাখার মুহূর্তটা দেখে যেতে পারেননি শেহতাজের বাবা মো. আবুল হাশেম মিয়া। ফলে বিয়ের আয়োজন পরিকল্পনায় আসে পরিবর্তন। শুরু থেকেই ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের ইচ্ছা ছিল শেহতাজের। প্রীতমের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে উড়াল দিতে চেয়েছিলেন ব্যাংকক। কিন্তু বিয়ের বছর বাবা মারা যাওয়ায় মন ভেঙে যায় মেয়ের। ফলে দেশেই বিয়েটা সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে ভেবেছিলেন কক্সবাজারের কথা। সৈকতে করবেন বিয়ের আয়োজন। কিন্তু বাধ সাধে বালিয়াড়ি। অতিথিদের ভীষণ ঝক্কি পোহাতে হবে সাগরতীরের বালির কারণে। সেইসঙ্গে ঢাকা-কক্সবাজারের দূরত্বটাও মাথায় ছিল তাদের। ফলে সাগরের কিনারে বিয়ের পরিকল্পনা ঝেড়ে ফেলেন মাথা থেকে। এরপর বেছে নেন সবুজে ঘেরা সিলেটের শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলের পাঁচ তারকা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফে হয় অনুষ্ঠান। তবে এজন্য কম ঝাক্কি পোহাতে হয়নি শেহতাজ-প্রীতমকে। বিয়ের ভেন্যু নির্বাচনে খুশি ছিলেন না দুই পরিবারের মুরুব্বীরা। এতদূরে বিয়েতে মোটেই মত ছিল না তাদের। বুঝিয়ে সুঝিয়ে সবাইকে রাজি করান প্রীতম-শেহতাজ। অতঃপর ২৮ অক্টোবর এক শৈল্পিক আবহের মধ্যে চা’য়ের দেশে ভালোবেসে চার হাত এক করেন তারা।

আর এটাই ছিল নেটিজেনদের জন্য চমক। বলা চলে প্রীতম-শেহতাজের বিয়েটা ছিল চমকের ফুল প্যাকেজ। তারকাদের মন দেওয়া নেওয়াটা যতই গোপনে চলুক না কেন প্রকাশ পেতে সময় লাগে না। এদিক থেকে প্রীতম ও শেহতাজকে পরিপক্ক বলা চলে। কেননা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সম্পর্কের খবর উঠে আসেনি সংবাদমাধ্যমে। বলা চলে বেশ সাবধানে পা ফেলেছেন তারা। একারণেই হুট করে বিয়ের খবর পেয়ে চমকে উঠেছিলেন সবাই। সেইসঙ্গে বিয়ের স্থান নির্বাচনের ভিন্নতা তাদের করেছিল কৌতুহলী। চা বাগানে কোথায় কীভাবে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন এই তারকা জুটি? সেসব নিয়ে উৎসুক ছিলেন নেট নাগরিকরা। তবে নেটিজেনদের সে আগ্রহ মেটাতে কার্পণ্য করেননি প্রীতম শেহতাজ। নিজেদের ফেসবুকে বিয়ের ছবিগুলো প্রকাশ করে অনুরাগীদের ক্ষুধা মেটান তারা।

প্রীতম ও শেহতাজের বিয়েতে যেন এক ঝাঁক তারা নেমে এসেছিল আকাশ থেকে। নাটক ও সংগীতাঙ্গনের মানুষদের মিলন মেলা বসেছিল সবুজের বুকে। নাচে গানে বেশ জমে উঠেছিল। বিয়ের পর জাপানে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুজনের। তবে তার আগেই মিনি হানিমুন সেরে ফেলেন কক্সবাজারে। এ খবরও সামাজিকমাধ্যম থেকে পেয়েছিলেন সবাই। একদিন হঠাৎই নিজেদের ফেসবুকে যুগলবন্দী ছবি দেখা যায় তাদের। ক্যাপশন ছিল মিনি হানিমুন। বোঝাই যাচ্ছিল একান্তে সময় কাটাতে সাগরকেই বেছে নিয়েছেন তারা। এদিকে বিয়ের কয়েক মাস কেটে গেছে এই যুগলের।

ফের কাজে মন দেন প্রীতম। শেহতাজও উঠেছিলেন মায়ের বাসায়। এবার ঈদ পর্যন্ত সেখানেই থেকেছেন। প্রীতম থেকেছেন তার বাসায়। ভাবতে পারেন কেন এই পৃথক বাস। কারণ তখনও বাসা গুছানো হয়নি তাদের। নতুন সংসারে কতকিছু লাগে। সেসব কিনতেও লাগে পরিকল্পনা ও সময়। কিন্তু শেহতাজ আবার পরিকল্পনা করে কিছু করতে পারেন না। তাই নতুন বাসায় ওঠার হ্যাপা একবারে কাঁধে না নিয়ে করছিলেন একটু একটু করে। সেকারণেই লেগেছে সময়। সব গোছানো শেষে ঈদের দিন নতুন সংসারে ওঠার জন্য নির্ধারণ করেন তারা। নিশ্চয়ই মনে হতে পারে বিয়ের পর এবারই প্রথম ঈদ গেল তাদের। কেমন কেটেছে দিনটি তাদের। ওই যে বললাম দুটি কারণে ঈদটা বিশেষ ছিল তাদের। প্রথমত, বিয়ের পর প্রথম ঈদ। আর দ্বিতীয়ত, দিনটি ছিল তাদের লেকসিটির নতুন বাসায় ওঠার দিন। এসব করেই দিনটি উদযাপন করেছেন তারা।

দুপুর পর্যন্ত স্টুডিওতেই কেটে গেছে প্রীতমের। ব্যস্ত ছিলেন কাজ নিয়ে। অন্যদিকে শেহতাজ তার অপেক্ষায় বসেছিলেন। দুজনের দেখা হয় যখন সূর্য তখন মধ্যগগন পেরিয়েছে। ঈদের অন্যতম একটি রেওয়াজ হচ্ছে সালামী প্রদান। সালামী শুধু ছোটরাই বড়দের থেকে নেয় না। স্ত্রীও স্বামীর থেকে নিয়ে থাকে। শেহতাজ ছিলেন অপেক্ষায়। প্রীতম এলেই আদায় করে নেবেন। কিন্তু তা আর করতে হয়নি। প্রীতম বাসায় ঢুকে নিজেই তার হাতে গুঁজে দিয়েছেন সালামী। কত জানেন? শেহতাজকে পঞ্চাশ হাজার টাকা সালামি দিয়েছেন প্রীতম। চোখ কপালে উঠে গেল না? ভালোবাসা এমনই। অংকটা আমাদের কাছে বড় হতে পারে কিন্তু প্রীতম তো শেহজাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। তার কাছে হয়তো মামুলী বিষয়। সবে এক ছাদের নিচে উঠেছেন। সংসার যাপনের অভিজ্ঞতা হয়নি এখনও। তারা বিবাহিত জীবনটা এখনও নতুন দুজনের কাছে। আর সংসার নিয়ে পরিল্পনা? এমনিতেও কোনো কিছু পরিকল্পনা করা হয় না শেহতাজের। তাছাড়া যৌথ জীবনের শুরুতে একটু জিরিয়ে নিতে চাচ্ছেন এ দম্পতি। তারপর বাকি সব।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দাম্পত্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine − 6 =