ইরানী বিশ্বাস
একসময় আমি টিউশনি করতাম। এক বিহারি পরিবার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে লালমাটিয়ায় আমার পাশের বাসায় ভাড়া থাকতো। তাদের একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি তখন ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়েছিল। শুধু তার বাবা চাইতেন মেয়েটি পড়ালেখা করুক। আর দাদি চাইতেন বিয়ে দিতে। আমার সঙ্গে পরিচয় থাকাতে বিয়েতে বাধা দিলাম। তখন তাদের আবদার আমি যেন তাকে পড়াই। আমার কাছে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছে, তারপর তার বিয়ে হয়ে গেল। আর যোগাযোগ ছিল না।
কিছুদিন আগে আমি লালমাটিয়া যাবার পর মনে পড়লো তাদের কথা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম পাশের সুন্দর সাদা বাড়িটি তাদের। বাড়ির জায়গা আগেই কেনা ছিল জানতাম। সেই জায়গায় ৮তলা বাড়ি করেছে। সমস্ত বাড়ি সাদা মার্বেলে তৈরি। বাইরে থেকে দেখতে রাজপ্রাসাদ মনে হয়। গেটে দারোয়ানের কাছে পরিচয় দিতেই ইন্টারকমে আমার কথা জানালো। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই দেখি ছাত্রীর মা নিচে চলে এসেছেন। দোতলায় নিয়ে গেলেন আমাকে। সেখানে ছাত্রীর বাবা-মা-দাদি থাকেন। আর বাকি ৬ ভাই-বোন ৬তলায় থাকে। নিচে গ্যারেজ। আমার কথা শুনে সকলেই এসেছেন। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো সাদা মার্বেলের ড্রইং রুম জুড়ে একটি ভেড়া এবং ছাগলের বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আগে থেকেই জানতাম, এই পরিবারে ভেড়া-ছাগল পোষা হয়। এক বছর পোষার পর কুরবানি দেওয়া হয়। এতক্ষণ যে গল্পটা বললাম, এর অর্থ হলো উন্নয়ন যা-ই হোক না কেন, স্বভাব পরিবর্তন না হলে মার্বেল টাইলসের ৮তলা বাড়িতেও ছাগল-ভেড়া পালন করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায়নের ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়ন এবং নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বিশ্বের বিস্ময়। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
২০০৯ সাল থেকে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহারে স্বপ্ন ছিল রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের। এরপর ২০১৪ সালের সরকার গঠন করে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ স্লোগানের ইশতেহার দিয়ে। গ্রহণ করে ১০টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইশতেহার প্রণয়ন করে।
গত ১৪ বছরে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, তিস্তা সেতু, পায়রা সেতু, দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু, দ্বিতীয় মেঘনা সেতু, দ্বিতীয় গোমতী সেতুসহ শত শত ছোট বড় সেতু। এছাড়া সড়ক বিনির্মাণে রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ এবং পুনঃনির্মাণেও রয়েছে দারুন সাফল্য। এরই মধ্যে ১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ে উদ্বোধন হয়েছে। ইতিমধ্যে দ্রুতগতির উড়ালসড়কের ১১.৫ কিলোমিটার উদ্বোধন করা হয়েছে। যানজটের শহরে উড়াল সড়কের সাহায্যে এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১০ মিনিটে ফার্মগেট পৌঁছানো যাবে। এক্সেপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। এই র্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এক যুগ আগে প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের উদ্বোধন হয়েছে। নদীর তলদেশে ১৮-৩১ মিটার গভীরে ৩.৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য করা হয়েছে টানেলটি যা মাত্র ৩ মিনিটে পার হওয়া সম্ভব। নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে সারাদেশে যোগাযোগের জন্য নির্মিত হয়েছে সড়ক-মহাসড়ক। টু লেন, থ্রি লেন, ফোর লেনের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে অনেক জায়গায়। কোথাও আবার নতুন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে বিনির্মাণে সতত চেষ্টা রয়েছে সরকারের। সারাদেশে কয়েকশ’ মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ভূমিহীনদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের ইশতেহারের প্রায় সব কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তারপরও কেন বাংলাদেশের মানুষ সন্তুষ্ট নয় উন্নয়ন নিয়ে?
বর্ষাকাল বা অন্য যেকোন ঋতুতে বৃষ্টি হলে ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তা ডুবে যায়। রাস্তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অনেক সময় রিকশার পাদানি ডুবে যায়। সিএনজি অটো রিকশায় পানি ঢুকে বিকল হয়ে পড়ে। প্রাইভেট কার চালানো সম্ভব হয় না। একারণে যাতায়াতের সময় যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ফলে অধিকাংশ সময় যাত্রীরা সরকারকে গালাগালি করে থাকে। অনেকেই বলে থাকেন, ‘এতো উন্নয়নের বুলি ছাড়েন, রাস্তায় তো চলতে পারি না’।
নাগরিক জীবনে এসব চিত্র দেখতে বা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সরকার বলতে আলাদা কোনো ব্যক্তি নেই। সরকারি ব্যক্তি, দল, মত, সংবিধান, রাষ্ট্রিয় কাঠামো সবই বদল হয়। অর্থাৎ সরকার সর্বদা একটি বদল প্রক্রিয়া। একটু বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই, প্রতিটি দলের সরকার গঠনের সময় দেশের প্রতিটি মানুষেরই কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজন সরকারের অর্ন্তভুক্ত থাকে। অথচ জনগণ এবং সরকারের মধ্যে বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজমান। জনগণ সরকারকে প্রতিপক্ষ মনে করে।
সরকার রাস্তা নির্মাণ করে সাধারণ জনগণের জন্য। নির্মাণ খরচ ধার্য্য করা হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে। রাস্তা আমাদের, রাস্তার উন্নয়ন করা হয় আমাদের জন্য। অথচ সেই রাস্তায় চলার সময় এই আমরাই হাতের কাছে যা-পাই তাই ফেলে রেখে যাই। রাস্তা পরিস্কার করা হয় দিনে একবার। খুব সকালে। ভেবে দেখুন, আপনি আবর্জনা দিনের প্রথম ভাগে ফেলে গেলেন। আর তার কিছুক্ষণ পর প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। তাহলে আবর্জনা অবশ্যই ড্রেনে গিয়ে আটকে যাবে। যথাযথ পানি নিষ্কাশন না হওয়ার দরুন রাস্তায় পানি জমে গেল। আর সেই পানিতে আপনি নিজেই ভোগান্তির শিকার হলেন। দোষটা তখন কাকে দিবেন, সরকারকে নাকি নিজেকে?
ঠিক তেমনি, আমাদের জাতীয় সম্পদ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ আমরা যথাযথ ব্যবহার করি না। অনেক বাড়িতে গ্যাস ব্যবহারে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। সারাদিন চুলা জ্বলতে থাকে। অধিকাংশ মানুষ মনে করে সারা মাসের বিল দেওয়া হয়। সুতরাং গ্যাস যা পোড়াতে পারি সমস্যা কোথায়? একবার ভেবে দেখেছেন, আপনার মতো যদি ১৬ কোটি মানুষ এমন ধারনা পোষণ করে, তাহলে প্রাকৃতিক এই সম্পদটি শেষ হতে কতো সময় লাগবে? মাসের বিল দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যথাযথ ব্যবহারের প্রয়োজন। ঠিক তেমনি, পানি, বিদ্যুৎতের ক্ষেত্রেও একই ধারনা রয়েছে।
সরকার আধুনিক জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দিলেও আমাদের অজ্ঞতার কারণে আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হতে পারছি না। ডিজিটাল বাংলাদেশে সহজ শর্তে অল্প খরচে ইন্টারনেট হাতের নাগালে। অথচ ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। বরং ইন্টারনেট অপব্যবহার করে অলস জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
সরকার আমাদের জীবন-যাপনের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, কর্ণফুলি টানেল, পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার করা জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। নৈতিকতা এবং দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পারিবারিক শিক্ষার মধ্যেই পড়ে। প্রতিটি পরিবার শিশুকে দেশপ্রেম শিক্ষা না দিলে শিশুরা দেশের সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে জানবে না। যতদিন জনগণের মধ্যে আত্মউপলব্ধি না জন্মাবে ততদিন দেশের কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না। উপরিউক্ত গল্পের মতো মার্বেল টাইলসের আটতলা বিল্ডিং বানাতেই পারে। তবে সঠিক ব্যবহার না জানার কারণে ঘরের মধ্যে ভেড়া-ছাগল পালন করবে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন জনগণের আত্মউন্নয়ন, মানবিক উন্নয়ন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ