‘প্লাস্টিক খাদক ব্যাকটেরিয়া’ নিয়ে আশাবাদ

মুশফিকুর রহমান
কিছুদিন আগে রিপোর্ট দেখেছিলাম, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৩০% কমিয়ে আনতে চায়। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় বাংলাদেশের জাতীয় কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে লক্ষ্য পরিপূরণে সরকার ও বিশ^ব্যাংক যৌথভাবে কাজ করার কথা ঘোষণা করেছে। সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বর্জ্যরে পরিমাণ কমানো, তার পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করছে। কর্মপরিকল্পনায় অন্যান্যের মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৫০% পুনঃচক্রায়ন, ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ৫০% হ্রাস এবং পর্যায়ক্রমে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৯০% কমিয়ে আনবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের  পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন এবং এর ১০% প্লাস্টিক বর্জ্য। আরও লক্ষ্য করার বিষয়, দেশে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক উপাদানের অন্তত ৪৮% বর্জ্যরে ভাগাড়ে পাওয়া যায়, ৩৭% প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন হয়, ৩% নালা নর্দমায় নিক্ষেপিত হয় এবং ১২% বর্জ্য প্লাস্টিকের জায়গা হয় শেষ অবধি নদী বা সমুদ্রে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে প্রধানত পাওয়া যায় একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক ব্যাগ, মোড়ক, প্যাকেজিং সামগ্রি ও বহুস্তরের প্লাস্টিক উপাদান ইত্যাদি। দ্রুত নগরায়নের ফলে বাংলাদেশে দ্রুত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির সাথে দেশে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক ব্যবহার বাড়বে, সেটি হয়তো অস্বাভাবিক নয়; তবে প্লাস্টিক পণ্যের বর্জ্য নিয়ে অব্যবস্থাপনা হলো উদ্বেগের বিষয়।

বিশ্বজুড়েই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন একটি বড় মাথা ব্যাথার বিষয়। প্লাস্টিক পণ্যের উপর মানুষের নির্ভরতা যত বাড়ছে, প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণও সেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গ প্রায় প্রতিটি পণ্যের উৎপাদনে এখন প্লাস্টিকের ভূমিকা অবধারিত হয়ে উঠছে। এমনকি ইলেকট্রনিক্স, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, পরিবহন প্রযুক্তি, প্রায় সব ধরনের পণ্যের প্যাকিং ও প্যাকেজিং প্লাস্টিক ছাড়া ভাবা প্রায় অসম্ভব। প্লাস্টিকের বৈশিষ্ট্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফলে হালকা, টেকসই, সস্তা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য উপাদান হিসেবে প্লাস্টিকের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক উপাদানের অন্তত ৫০% একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিকপণ্য। বিজ্ঞানীদের অনুমান, পৃথিবীর সমুদ্র-মহাসমুদ্রে যে পরিমাণ প্লাস্টিক জমা হচ্ছে, তাতে ইতিমধ্যে না হয়ে থাকলে, শিঘ্রী সমুদ্র-মহাসমুদ্রের সমুদয় মাছের ওজনের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ওজন বেশি হবে ।

প্লাস্টিক সহজে পচে না; এমনকি তা অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণায় ভেঙে গেলেও পচে না। জল, স্থল, অন্তরীক্ষে যে হারে প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে তার প্রভাব কি হবে তা-ও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। ইতিমধ্যে এ তথ্য জানা যে মানুষের খাদ্যচক্রে প্লাস্টিক নিয়মিত অনুষঙ্গ হয়েছে। তাছাড়া, প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার জন্য চুড়ান্ত বিচারে কার দায় কত সে বিষয়েও তর্ক রয়েছে। বিশে^ ব্যবহৃত প্লাস্টিকপণ্য প্রধানত উৎপাদিত হয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও জাপানে। সৌদি আরব, তাইওয়ান এবং চীনও প্লাস্টিক উৎপাদনে খুব পিছিয়ে নেই। তবে প্লাস্টিক যেখানে উৎপদিত হয়, তার অধিকাংশ ব্যবহার হয় উৎপাদক থেকে অনেক দূরে। একইভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার স্থল থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দূরত্বে প্লাস্টিক বর্জ্য নিক্ষেপিত হয়। যেমন, সমুদ্রে নিক্ষেপিত প্লাস্টিকের সিংহভাগ জাহাজের বর্জ্য, বাতিল মাছের জাল ও অন্যান্য মাছ ধরার আয়োজনের সাথে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্রে যথেচ্ছ বর্জ্য ফেলায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা সামান্যই মানা হয় ।

প্লাস্টিক উপাদান ব্যবহার নিয়ে সাধারণভাবে মানুষের প্রবণতার সাথে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনের যোগসূত্র রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যবহারে মানুষ সরল রৈখিকভাবে ভাবতে অভ্যস্ত। অর্থৎ, প্লাস্টিক উৎপাদন-প্লাস্টিক ব্যবহার এবং বাতিল প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া। প্লাস্টিকপণ্য ব্যবহারে মানুষের এই সরল রৈখিক আচরণ প্রবণতার পরিবর্তন করা গেলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ কমবে। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন যেন কম হয় সে লক্ষ্যে বর্জ্য প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার (রি-ইউজ) এবং পুনঃচক্রায়নের (রিসাইকেল) বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টিতে মনযোগ দিতে হবে। তবে প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়নের খরচ সাধারণভাবে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি হওয়ায় বিশেষ প্রণোদনা বা আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলে তা করতে কেউ আগ্রহী হতে চায় না। তাছাড়া সব প্লাস্টিকের ধরন, বৈশিষ্ট্য এক নয়। বর্জ্য প্লাস্টিকের মধ্যে এক ধরনের প্লাস্টিক উপস্থিত না থাকায়, কার্যকরভাবে তার পুনঃচক্রায়ন করা দুরূহ।

বিজ্ঞানীগণ দীর্ঘদিন গবেষণা করে ‘প্লাস্টিক খাদক ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক’ চিহ্নিত করেছেন। বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক খাদক অণুবীক্ষণিক জীবেরা (ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক) সাধারণত পরিবেশে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সক্রিয়। যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকগণ সম্প্রতি একধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎসরিত ‘এনজাইমের’ সন্ধান পেয়েছেন যা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত পলিয়েস্টার প্লাস্টিক (পলিইথিলিন টেরেফথালেট বা পিইটি যা পানীয় বোতল, খাদ্য উপাদান প্যাকেজিং উপাদান উৎপাদনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; একইভাবে তা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়) দ্রুত ভেঙে ফেলতে সক্ষম।

জাপানের কিয়োটো ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র বিজ্ঞানীগণ ২০১৬ সালে আবিষ্কার করেন যে বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়াজাত এনজাইম পিইটি জাতীয় প্লাস্টিকের ‘পচনে’ সহায়তা করে। তাছাড়া জার্মান বিজ্ঞানীগণ পলিইউরইথেন (ফোম ইনসুলেশন, রান্নাঘরে ব্যবহৃত স্পঞ্জ, জুতা তৈরির স্পঞ্জ, ডায়াপার উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান) ভেঙে ফেলার (পচনে সহায়ক) ইন্ধন দেওয়া এক ধরনের ছত্রাক আবিষ্কার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রিনিউএবল এনার্জি ল্যাবরেটরি, সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট ডব্লিউএসএল-এর বিজ্ঞানীগণও দ্রুত প্লাস্টিক ‘পচনে’ সহায়ক একাধিক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক চিহ্নিত করেছেন। এই সকল আবিষ্কার প্লাস্টিক বর্জ্যব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করেছে।

তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার উপযোগী ‘প্লাস্টিক খাদক’ ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এর কাছাকাছি তাপমাত্রায় সক্রিয় হলে তা আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় হবে। বিজ্ঞানীগণ আশা করছেন আগামী ১০ বছরের মধ্যেই প্লাস্টিক খাদক ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হবে। তবে ততদিন অপেক্ষায় না থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য কম উৎপাদন করা, বর্জ্য প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়ন ও পুনর্ব্যবহারের অন্যান্য উপায় সমূহকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 + one =