‘প্লাস্টিক দিন, উপহার নিন’ প্রকল্পে ব্যাপক সাড়া

সেলিনা শিউলী 

নিত্যপণ্য ও সৌখিন পণ্যের বিনিময়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রায় ৪৫ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা পড়েছে। আগত পর্যটক ও স্থানীয়রা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বোতল জমা দিলেই পাচ্ছেন ‘সৌখিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাসসকে বলেন, প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে পরীক্ষামূলকভাবে চার মাস মেয়াদে ‘প্লাস্টিক একচেঞ্জ স্টোর’-এ উদ্যোগ নেয়া হয়। পর্যটকরা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বোতল জমা দিয়ে বিভিন্ন উপহার পাচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন মৌসুমকে কেন্দ্র করে ‘সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ কর্মসূচি’ শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট ও ইনানী পয়েন্টে দুটি এবং সেন্টমার্টিনে একটি ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোর’ (প্লাস্টিক দিন, উপহার নিন) স্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজার এবং দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন চরম পরিবেশ দূষণে পড়ায় চার মাস মেয়াদি এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।

তিনি বলেন, পর্যটকরা সৌখিন পণ্য পেয়ে যেমন খুশি হচ্ছেন তেমনি স্থানীয় দুঃস্থ মানুষ প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য পছন্দমত নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী এই স্টোর থেকে নিতে পারছেন। ৭ নভেম্বর ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রম চলবে ৭ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত। বর্জ্য সংগ্রহ গতকাল ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ টন। ‘প্লাস্টিক দিন, উপহার নিন’ এই উদ্যোগে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ১৩২ জন উপহার সামগ্রী পেয়েছেন।

জেলা প্রশাসন জানায়, উপহার সামগ্রীতে প্রদানকৃত পণ্যের বাজার মূল্য প্রায় ৩২ লাখ ৮৩ হাজার ২শ’ টাকা। উপহার সামগ্রীতে খাদ্য পণ্যও বিতরণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগে প্রথম দিকে সাড়া না মিললেও ধীরে ধীরে এটি কৌতুহল ও আগ্রহ সৃষ্টি করে।

জেলা প্রশাসক বলেন, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারবে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে খুব ভাল ন্যাচারাল রিসোর্সেস হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এই এলাকা আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক।

তিনি আরো আরো বলেন, পরিবেশ দূষণ থেকে সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে জাহাজ ঢুকতে দেয়া হলেও পলিথিন নেয়া বন্ধ করা হয়েছে। ‘কাগজে-কলমে ‘শুন্য পলিথিন’ কথাটি শুনতে ভাল শোনালেও দু:খের বিষয় এখনো পলিথিনের কোন বিকল্প নেই। যেহেতু এর বিকল্প মাঠে নেই, উদ্যোক্তারাও বাজারজাত করে নাই সেক্ষেত্রে এটা মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ‘শুন্য পলিথিন’ অবস্থার মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহারও সীমিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

‘প্লাস্টিক দিন,উপহার নিন’ প্রকল্প কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে স্থানীয় ও দুস্থদের কাছে এই প্রক্রিয়া তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে একটু হলেও সুসংহত করেছে, পাশাপাশি পরিবেশও রক্ষা পাচ্ছে। এই কার্যক্রম শুরুর পর গতকাল পর্যন্ত মোট ৪৫ টন ‘প্লাস্টিক বর্জ্য’ সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব স্টোরে পর্যটক ও স্থানীয়রা সিঙ্গেল প্লাস্টিক বোতল জমা দিলেই বিনিময়ে পাচ্ছেন সৌখিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। যদি টুরিষ্ট হন তাহলে তারা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বোতল জমা দেয় তার ওজন বুঝে ক্যাপ (টুপি), শিশুদের গল্পের বই, ছোট সূভ্যানির, সানগ্লাস পেয়ে যাচ্ছেন।

যেমন দুই কেজি প্লাস্টিক জমা দিলে যে কেউ একটি ক্যাপ পেতে পারেন। যা কিনতে হলো না, আবার পরিবেশও দূষিত হলো না।

অন্যদিকে, স্থানীয়দের বড় একটা অংশ প্রতিদিন প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে এই স্টোরে জমা দিয়ে তার বিনিময়ে তাদের সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পেয়ে যান। ১৯টি পণ্য থেকে তারা নিজের চাহিদা মতো পণ্য বাছাই করে বিনিময় করতে পারেন। এক কেজি প্লাস্টিক জমা দিয়ে এক কেজি চাল বা ডাল সংগ্রহ করতে পারেন। ১ কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ১ কেজি লবণ, তিন কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে  ১ কেজি চিনি এরকম। বা কেজিতে পেতে পারেন ছয়টি ডিমও।

একেক জন প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ কেজি প্লাস্টিকের বোতল জমা দিয়ে থাকে। অনেকে চালের পরিবর্তে তেল, নুডলস, সেমাই, আটা, বিস্কুট, চিনি ও লবণ নেন। যা বাজারের নির্ধারিত দামের চেয়েও অপেক্ষাকৃত কম মূল্য ধরে দেওয়া হয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, সংগৃহীত প্লাস্টিক রিসাইকেলের জন্য প্রাণ-আরএফএলসহ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। জমাকৃত প্লাস্টিকের একটি অংশ দিয়ে জনসচেতনতার লক্ষ্যে সুগন্ধা পয়েন্টে ভেতরে বাঁশের ফ্রেম এবং বাইরের স্ট্রাকচারে প্লাস্টিকের সব বর্জ্য থেকে প্রায় ৬২ ফুট উঁচু ‘প্লাস্টিকের দানব’ তৈরি করা হয়েছে। আমরা এই দানব প্রদর্শনের মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যবহারের কুফল জনসাধারণকে বোঝাতে চাচ্ছি। দর্শনার্থীরা এখানে এখন এই প্লাস্টিকের দানব দেখতে আসে।

জেলা প্রশাসন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, টুরিস্ট পুলিশ জনস্বার্থে কক্সবাজারের প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরের সাইনবোর্ডে প্লাস্টিকের দানবের ছবি দিয়ে ‘এই দানব জন্মাবে না আর, প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে হবে সবার’ এই স্লোগান যুক্ত করেছেন।

কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে আসা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আহনাফ শাহরিয়ার হক ও বাগেরহাটের একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাজোয়ার তাহমিদ বাসস’কে জানান, বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছি। একটি সৌন্দর্যময় স্থান এবং একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কক্সবাজারের বেলাভূমিতে প্লাস্টিকের বর্জ্য দেখলাম। তবে সেন্টমার্টিনে তুলনামূলক কম বর্জ্য দেখেছি। তবে‘প্লাস্টিক একচেঞ্জ স্টোর’ চোখে পড়েছে। এটি চমৎকার একটি আইডিয়া। আশা করছি এর মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রক্ষা পাবে।

তাহমিদ বলেন, সেন্টমার্টিনে এবারই প্রথম এসেছি। জাহাজে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নানা ধরনের নির্দেশনা থাকলেও দর্শনার্থীদের অসচেতনতাও দেখা গেছে। আশার কথা এই যে, জাহাজে দায়িত্বে থাকা লোকজন বারবার পরিবেশ দূষণ বিষয়ে সতর্ক করে সচেতনতার তাগিদ দেন। পরিবেশ রক্ষায় এটা অসাধারণ পদক্ষেপ।

ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ও বেলার নেটওয়ার্ক মেম্বার ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে বর্তমানে বসবাসরত ১৭শ’ পরিবারের ছোট-বড় ৮ হাজার মানুষের প্রতিদিন দুই টন করে মনুষ্য বর্জ্য ও দুই টন কঠিন বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি পর্যটন মৌসুমের তিন মাসে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটকের চার হাজার প্লাস্টিকের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট ও চিপসসহ অন্যান্য প্লাস্টিক-পলিথিনের প্যাকেটজাত নিত্যপণ্যের বর্জ্যও তৈরি হচ্ছে।

তিনি জানান, এসব বর্জ্যরে কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়েছে। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সেন্টমার্টিনে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্নভাবে  কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সভা ও বর্জ্য সংগ্রহ অন্যতম।

ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার খুবই উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারীভাবে নেওয়া নানা পদক্ষেপ, বিশেষ করে পর্যটক সীমিতকরণের ফলে অনেকটা কমে এসেছে এর ব্যবহার। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শিগগিরই সেন্টমার্টিনে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের বহুমুখী নির্দেশনা ও উদ্যোগের পাশাপশি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে মাঠ পর্যায়ে সবাই কাজ করছে।

বাসস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 + 2 =