ঢাকা, ৫ জুন ২০২৫ — পরিবেশ দিবস ২০২৫-এ চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশ এখন সীমান্ত পেরিয়ে আসা নদীগুলোর মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণের ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ের মুখোমুখি — যা দেশের উপকূল, জীববৈচিত্র্য, মৎস্যসম্পদ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর নতুন প্রতিবেদন “Cross-Border Plastic Pollution and Its Impact on the Bay of Bengal” অনুসারে, প্রতিদিন ১৮টি সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীর মাধ্যমে ১৫,৩৪৫ টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে — যা বৈশ্বিকভাবে অন্যতম উচ্চ প্রবাহমান হার। এই প্লাস্টিকসমূহ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে জমা হচ্ছে, যেখানে তা সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করছে, মৎস্য খাত ব্যাহত করছে এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
প্লাস্টিকের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আজ “প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে” পরিণত হয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, উপকূলীয় জীবিকা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। প্রতিবছর প্রায় ১১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পরিবেশগত সেবা বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশগুলো হারাচ্ছে সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের কারণে।
বিশ্বব্যাপী এশিয়ার নদীগুলো সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ৮৬% পর্যন্ত অবদান রাখছে — গঙ্গা নদী বৈশ্বিকভাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্লাস্টিক-নিঃসরণকারী নদী, যা প্রতিবছর ১,১৫,০০০ টন পর্যন্ত প্লাস্টিক সমুদ্রে নিক্ষেপ করছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জাকির হোসেন খান বলেন:
“আমাদের উপকূল এখন একটি প্লাস্টিক দূষণের হটস্পটে পরিণত হয়েছে।”
*”দূষণকারীরা ক্ষতিপূরণ দেবে — রাষ্ট্র নয়, বরং প্লাস্টিক উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রধান কর্পোরেট সংস্থাগুলোকেই টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করা হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বৈশ্বিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এর উৎপাদন ও ব্যবহার কমাতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দৃষ্টান্তমূলক প্রণোদনা প্রয়োগ করতে হবে। প্রাকৃতিক অধিকার ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার (Natural Rights Led Governance – NRLG) সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ‘জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা’ (পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর মহাসাগরের অধিকার) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ECA) এবং মৎস্য অঞ্চলের নিকটে ক্ষতিকর প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে হবে; প্লাস্টিক-নির্ভর উপকূলীয় শিল্পের জন্য দূষণের প্রভাব মূল্যায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; এবং কারিগরি জেলেরা ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর প্লাস্টিক-মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে, কারণ তাদের জীবিকা ও স্বাস্থ্য এর উপর নির্ভরশীল।
প্রকৃতি-ন্যায় (Nature Justice) এবং মহাসাগরের আইনগত ব্যক্তিসত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট সামুদ্রিক অঞ্চল (যেমন সুন্দরবন, প্রবাল প্রাচীর, মোহনা অঞ্চল) কে প্রাকৃতিক অধিকারের স্থান (Natural Rights Sites) হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এসব সামুদ্রিক অঞ্চল বা বাস্তুতন্ত্রকে আইনি ব্যক্তিসত্তা প্রদান করতে হবে যাতে তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে — একে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এতে স্থানীয় জনগণের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শিল্পজাত প্লাস্টিক দূষণ ও ‘ঘোস্ট গিয়ার’-এর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধ শক্তিশালী হবে। প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) এবং প্রাকৃতিক জবাবদিহিতা (Natural Accountability) নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং বিশেষ করে সামুদ্রিক পরিবেশে নিম্নধারার (downstream) দূষণের জন্য Extended Producer Responsibility (EPR) প্রয়োগ করতে হবে। উপকূলীয় ও নৌপরিবহন শিল্পে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ন্যায় এবং আন্তঃপ্রজন্মিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্লাস্টিককে সার্কুলার অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে পুনর্ব্যবহারের সুফল যেন কর্পোরেশন বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা একচেটিয়াভাবে দখল না করা হয়, বরং সমানভাবে বণ্টিত হয়।
উপকূলীয় কমিউনিটি ইউনিট (যার ৫০% নারী ও যুবক অন্তর্ভুক্ত) গঠন করে তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে যাতে তারা সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য পর্যবেক্ষণ, ‘ঘোস্ট গিয়ার’ রিপোর্ট করা এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের হটস্পটসমূহ যৌথভাবে পরিচালনা করতে পারে। এর জন্য রিয়েল-টাইম মেরিন প্লাস্টিক মনিটরিং (মৎস্যজীবীদের জন্য মোবাইল অ্যাপ বা এসএমএস সিস্টেম ব্যবহার করে) চালু করতে হবে, যাতে তারা প্লাস্টিকের ঘনত্ব বা সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রতি হুমকির তথ্য সরাসরি জানাতে পারে।”
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর প্রতিবেদনে আহ্বান জানানো হয়েছে:
- সুন্দরবন ও উপকূলবর্তী নদী মোহনার মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চলসমূহের আইনগত স্বত্ব প্রদান — যাতে স্থানীয় জনগণ আইনি পথে দূষণকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে।
- উপকূলীয় ও নৌপরিবহন শিল্পে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের লাইফ সাইকেল ট্র্যাকিং বাধ্যতামূলক করা — Extended Producer Responsibility (EPR) কাঠামোর আওতায়।
- উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়ন করা — যার অন্তত ৫০% নারী ও যুবক থাকবে — তারা রিয়েল-টাইম প্লাস্টিক মনিটরিং টুল (মোবাইল অ্যাপ ও এসএমএস ভিত্তিক রিপোর্টিং) ব্যবহার করে সামুদ্রিক আবর্জনার হটস্পট গুলি পর্যবেক্ষণ ও যৌথভাবে ব্যবস্থাপনা করবে।
- ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ECA) এবং মৎস্যাঞ্চল সংলগ্ন অঞ্চলে বিপজ্জনক প্লাস্টিকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিতে হবে BIMSTEC এবং আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক চুক্তির (Global Plastics Treaty) আলোচনায় সীমান্ত অতিক্রমকারী প্লাস্টিক বর্জ্য মোকাবেলায় আঞ্চলিক চুক্তি প্রণয়নের ক্ষেত্রে।
জরুরি জাতীয় ও আঞ্চলিক পদক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশের উপকূল এই ক্রমবর্ধমান “বিষাক্ত বর্জ্যের পুল” এর প্রতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে।