ফিরে দেখা ঢালিউড ২০২৩

২০২৩ সাল শেষ। সারা বছর মুক্তি পেয়েছে অসংখ্য সিনেমা। এবছর মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার মধ্য থেকে আলোচনায় থাকা দশ সিনেমা নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন ফিরে দেখা ঢালিউড।

০১. মুজিব একটি জাতির রূপকার – শ্যাম বেনেগাল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক নির্মিত হয়েছে আর বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তা নিয়ে আগ্রহ জন্মাবে না তা হতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশক পর বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ভারতের খ্যাতিমান নির্মাতা শেম বেনগলের কাঁধে ছিল এটি নির্মাণের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল অধ্যায় উঠে এসেছে সিনেমায়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চরিত্রে আরিফিন শুভ এবং তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চরিত্রে দিব্য জ্যোতি। সিনেমাটি মুক্তির পর দর্শকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর মুক্তি পায় সিনেমাটি। ১৭৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটি বেশ আলোচনায় ছিল এবছর।

০২. সাঁতাও – খন্দকার সুমন

গণঅর্থায়নে নির্মিত ‘সাঁতাও’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। খন্দকার সুমন সিনেমাটি পরিচালনার পাশাপাশি গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। সাঁতাও একটি রংপুরী শব্দ। সাতদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হওয়ার সময়টাকে বোঝাতে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘সাঁতাও’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সাঁতাওয়ের সময়ে কৃষিনির্ভর সমাজে কেমন প্রভাব ফেলে, কৃষকদের সংগ্রামী জীবন এবং প্রান্তিক পটভূমি থেকে নারীদের সর্বজনীন সংগ্রাম ও প্রান্তিক মানুষের জীবনের কাহিনি কেন্দ্র করে ৯৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে।  রংপুর অঞ্চল ঘিরে কৃষকের সংগ্রামী জীবন, মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ ও মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প। এতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল ও ফজলুল হক। সিনেমার সংগীততে বিয়ের গীত, রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াইয়া সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে। এবছর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্যানোরমা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কার পায় চলচ্চিত্রটি। ভারতের অজন্তা-ইলোরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৮ম আসরের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয় ছবিটি। নেপাল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ‘গৌতম বুদ্ধ পুরস্কার’ পায় সাঁতাও। গণ অর্থায়নে নির্মিত সিনেমাটি সুন্দর নির্মাণের জন্য সকলের মাঝে সাড়া ফেলে।

০৩. ওরা ৭ জন – খিজির হায়াত খান

বাংলাদেশী অ্যাকশন ওয়ার ফিল্ম ‘ওরা ৭ জন’ যা ১৯৭১ সালের পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩ মার্চ মুক্তি পায় খিজির হায়াত খানের পরিচালিত সিনেমাটি৷। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ যাত্রাকে অনুসরণ করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট ব্যাপ্তির সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্তেখাব দিনার, খিজির হায়াত খান, জাকিয়া বারী মম, সাইফ খান সজীব, ইমতিয়াজ বর্ষণ, নাফিস আহমেদ, তূর্য, নাজিয়া খান অর্ষা। ওরা ৭ জন ছবির গান ও সংগীতায়োজন করেছেন নাজমুল আবেদিন ও রাজিব হোসেন। সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে দেখানো হয়নি।

০৪. আদিম – যুবরাজ শামীম

‘আদিম’ যুবরাজ শামীম পরিচালিত বাংলাদেশী নাট্য চলচ্চিত্র। সিনেমার গল্প আবর্তিত হয়েছে টঙ্গী রেলস্টেশনের পাশের ব্যাংকের মাঠ বস্তির মানুষের গল্প অবলম্বনে নির্মিত। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন তরুণ নির্মাতা যুবরাজ শামীম। যা ছিল নির্মাতার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। গণ-অর্থায়নে নির্মাতার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রসায়নের ব্যানারে নির্মিত এবং সহপ্রযোজক হিসেবে ছিল দুই প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালের ২৬ মে সিনেমাটি মুক্তি পায় দেশের প্রেক্ষাগৃহে। বাংলাদেশের সিনেমার ক্ষেত্রে অন্যমত সৎ নির্মাণ ছিল এটি। এতে অভিনয় করা সকলে প্রথম বারের মতো অভিনয় করেছেন বাদশা, সোহাগী, দুলাল, সাদেকেরা। গণঅর্থায়নে নির্মিত সিনেমাটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবের নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল বাংলাদেশের এ সিনেমা।

০৫. আম কাঁঠালের ছুটি – মোহাম্মদ নুরুজ্জামান

বাংলাদেশে শিশুতোষ সিনেমা নির্মিত হয়না বললেই চলে। ২০২৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘আম কাঁঠালের ছুটি’ যা নির্মাণ করেছিলেন মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। শরীফ উদ্দিনের ‘মইন্না ভাই বল্লা রাশি’ ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ৯৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটি। সিনেমাটির আন্তর্জাতিক সংস্করণের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সামার হলিডে’ এটি ১৮ই আগস্ট প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। কারো সাথে মিশতে না পারা আট বছর বয়সী একটি শহুরে ছেলে গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে এসে কীভাবে নতুন এক জগৎ আবিষ্কার করে, খুঁজে পায় বন্ধুত্ব আর রোমাঞ্চের স্বাদ, তারই আখ্যান এই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে সত্তর, আশি ও মধ্য নব্বই দশকের শিশু-কিশোরদের শৈশব কৈশোরের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। নস্টালজিক এক অনূভুতি দিয়েছে এক শ্রেণির দর্শকদের। এতে অভিনয় করা প্রতিটি শিশু প্রথম বাবের মতো ক্যামেরার সামনে এসেছেন। বেশকিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কৃত হয়েছে চলচ্চিত্রটি।

০৬. লোকাল – সাইফ চন্দন

২০২৩ সালে ঈদুল উল ফিতরে দর্শক মহলে আলোচনায় থাকা সিনেমা ‘লোকাল’। সাইফ চন্দনের নির্মিত সিনেমাটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন আদর আজাদ ও শবনম বুবলী। ছবির কাহিনি ও সংলাপ লিখেছেন ফেরারী ফরহাদ। আদর-বুবলী ছাড়াও ছবিতে অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর, সাঞ্জু জন, ইরানী, রেজওয়ান, এলিনা শাম্মী, আনোয়ার, স্বাধীন, শিমুল খান, মারিয়া, সামির, জাহিদ, শিবা শানু, ডন, বড়দা মিঠু, আহমেদ শরিফসহ অনেকে। সিনেমার গল্পে তুলে ধরা হয়েছে একটি মফস্বল এলাকার চিত্র। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সংগ্রাম, জীবনযাপনসহ তাদের নানা সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমার নির্মাণ সবাইকে আকৃষ্ট করেছিলো। মালায়াম সিনেমার একটা আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন নির্মাতা পর্দায়।

০৭. এম আর নাইন – আসিফ ইকবাল

১৯৬৬ সালের কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদ নামের প্রথম গ্রন্থের অনুসারে ‘এম আর-৯’ সিনেমাটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। সিনেমাটি নিয়ে দর্শক মহলে আগ্রহ শুরু হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল মাসুদ রানার বইয়ের পাতা থেকে রূপালী পর্দায় আগমন।

২০২৩ সালের ২৫ আগষ্ট আসিফ আকবর পরিচালিত বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনার স্পাই থ্রিলার চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। ১৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটিতে দেশীয় শিল্পীর পাশাপাশি বাহিরের শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। মাসুদ রানা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের এবিএম সুমন। সিনেমা তৈরি হচ্ছে এটা নিয়ে দর্শকদের যতটা আগ্রহ ছিল ঠিক ততটা আগ্রহ কাজ করেনি সিনেমা মুক্তির পর। সিনেমার নির্মাণ হতাশ করেছে সকল শ্রেণীর দর্শকদের।

০৮. প্রিয়তমা – হিমেল আশরাফ

রোমান্টিক অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা ‘প্রিয়তমা’ মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ঈদুল আজহাতে। ২০২৩ সালের সবচেয়ে আয়কৃত সিনেমার পাশাপাশি কথা ওঠে বাংলাদেশের সর্বাধিক আয়করা সিনেমার রেকর্ডও ভেঙেছে শাকিব খানের এই সিনেমা। শাকিব খানের ভক্তদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শক সিনেমাটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে ভিন্ন এক শাকিব খানকে ট্রেলারে দেখে। ২০২৩ সালের ২৯ জুন মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন হিমেল আশরাফ, যা তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটিতে শাকিব খানের বিপরীতে ছিলো কলকাতার ইধিকা পাল। অন্য রকম এক ভালোবাসার গল্প নিয়ে নির্মিত ‘প্রিয়তমা’ সিনেমা। সিনেমার গান, অভিনয় ও নির্মাণ নিয়ে প্রশংসায় কুড়িয়েছে পুরো টিম।

০৯. সুড়ঙ্গ – রায়হান রাফি

২০২৩ সালের ২৩ জুন ঈদুল আজহায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় রায়হান রাফির নির্মিত ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমাটি। এটি দর্শক মহলে সাড়া ফেলানোর অন্যতম কারণ ছিল ছোট পর্দার আফরান নিশোর বড় পর্দায় অভিষেক। এছাড়া রায়হান রাফির নিজস্ব একটা দর্শক মহল। সিনেমার গল্পটি সত্য ঘটনার আবছায়াতে নির্মিত। ২০১৪ সালের একটি চুরির ঘটনার সঙ্গে এই ছবির মিল পাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গ বানিয়ে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা চুরি করে সোহেল নামের একজন। ২ বছর ধরে সুড়ঙ্গ করলেও চুরির মাত্র দুই দিনের মধ্যেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সিনেমাটি ২০২৩ সালের সর্বাধিক আয়কৃত সিনেমার তালিকায় রয়েছে। সিনেমার টেকনিক্যাল দিক গুলো দর্শকদের বেশি আকৃষ্ট করেছে।

১০. অন্তর্জাল – দীপংকর দীপন

বাংলাদেশের প্রথম সাইবার অ্যাকশন থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘অন্তর্জাল’ মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ভিন্ন এক জনরার সিনেমা হওয়াতে দর্শকদের মাঝে ছিল তুমুল আগ্রহ। ৩ তরুণের বুদ্ধিভিত্তিক উদ্ভাবন আর সাইবার দুনিয়ার হামলা নিয়ে এক কল্পিত দুনিয়ার বাস্তব লড়াই দেখা যায় এই সিনেমায়। এতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, বিদ্যা সিনহা সাহা মীম, এবিএম সুমন ও সুনেরাহ বিনতে কামাল৷ সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন দীপংকর দীপন। ‘আগামীর যুদ্ধটা হবে সাইবারে, কতটা প্রস্তুত আমাদের যোদ্ধারা’ এই মূল ভাবনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম সাইবার থ্রিলার চলচ্চিত্র অন্তর্জাল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 + 5 =