উপল বড়ুয়া
কবি আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থের নামের মতো মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে, ‘বছর যায় বছর আসে’। নতুন বছর নিয়ে আসে নতুনত্বও। যা আজ নতুন, কালই সে অতীত। দেখতে দেখতে চলে এলো নতুন বছর ২০২৪। ২০২৩ কেমন কাটল আপনাদের? কেমন কাটল ক্রীড়া বিশ্বের? চলুন, একটু ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নেওয়া যাক। অতীত ঘুরে তার স্মৃতিচারণা করা যাক।
ট্রান্সফার মার্কেটে সৌদির দাপট: নতুন বছরের শুরুতে চমক বলতে ছিল জানুয়ারির ট্রান্সফার মার্কেট। আগের মাসে অর্থাৎ গত বছরের ডিসেম্বর সবসময় সময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে ক্রীড়ামোদীদের কাছে। কী হয়নি এ মাসে! ৩৬ বছর পর লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়, ফুটবলের রাজা পেলের মৃত্যু আর শেষদিনে ইউরোপের ফুটবল ছেড়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে যোগ দেওয়া। সবই তো হলো। রোনালদোর চুক্তির প্রভাবটা বুঝা গেল কয়েক মাস। এ যে ফুটবল বিশ্বের মানচিত্রই পাল্টে দিল! রোনালদোর দেখানো পথে হেঁটে সামার (গ্রীষ্মকালীন) ট্রান্সফারে সৌদির ফুটবলে নাম লেখান করিম বেনজেমা, সাদিও মানে, রবার্তো ফিরমিনো, নেইমারের মতো তারকারা। গত সামার ট্রান্সফারে ইউরোপ ফুটবলে জন্য হুমকি হয়ে উঠে সৌদি প্রো লিগ। টাকার বস্তা নিয়ে সৌদি ক্লাবগুলো কিনে নেয় নামি তারকাদের। ট্রান্সফার মার্কেটে টেক্কা দেয় ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর সঙ্গে। নড়েচড়ে বসে ফুটবল বিশ্ব। ইউরোপ থেকে একসঙ্গে এতো তারকার বিদায় যে এবারই প্রথম!
মায়ামিতে মেসি: বার্সেলোনার সঙ্গে অভিমান করে প্যারিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু পিএসজি অধ্যায় খুব বেশি ভালো হয়নি মেসির। দুই বছরের চুক্তি শেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড ঘোষণা দেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেজর সকার লিগে যাচ্ছেন। খেলবেন ইন্টার মায়ামিতে। এই ঘোষণার আগে ক্লাবটির সহ-সত্ত্বাধিকারী ডেভিড বেকহাম তার সাবেক ক্লাব পিএসজিতে গিয়ে দেখা করেন মেসির সঙ্গে। এলএমটেন সম্মত হওয়ার মেসেজ দেখে অবাক হোন তিনিও। আর্জেন্টিনা অধিনায়কের দিকে ইউরোপের অনেক ক্লাব হাত বাড়িয়ে রেখেছিল। বিশ্বরেকর্ড গড়া প্রস্তাব দিয়েছিল সৌদির একটি ক্লাব। তবে মেসি বেছে নেন সকার লিগকে। জুলাইয়ে সেরে ফেলেন আনুষ্ঠানিক চুক্তি। মেসিকে বরণ করতে ঢল নামে মায়ামিতে। অভিষেক ম্যাচ দেখতে ছুটে আসেন ক্রীড়াবিশ্বের অনেক নামি তারকা। আর কে না জানে, এখন মেসি মায়ামির অন্যতম আকর্ষণীয় ‘বস্তু’। যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা।
সিটির ট্রেবল, নাপোলির অপেক্ষার ইতি: কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘৩৩ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি।’ তবে ৩৩ বছরের মাথায় কথা রেখেছে নাপোলি। জিতেছে সিরি’আ। এর আগে ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সবশেষ স্কুদেত্তো জিতেছিল তারা। গত মৌসুম স্বপ্নের মতো কেটেছে ম্যানচেস্টার সিটিরও। ঘরোয়া সব শিরোপা আগে জেতা হলো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ অধরা ছিল তাদের। কোচ পেপ গার্দিওলার অধীনে সেই স্বাদ পেয়েছে সিটিজেনরা, সঙ্গে প্রথমবারের মতো ট্রেবল। প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পরে দ্বিতীয় ইংলিশ ক্লাব হিসেবে এই কীর্তি গড়ল সিটি। এরপরই নতুন মৌসুম শুরুর আগে তিন মাসের বিরতিতে শুরু হয় গ্রীষ্মকালীন দলবদল।
তামিম বনাম সাকিব: দুজনের বন্ধুত্ব উদাহরণ হয়ে উঠেছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে। ছিল গলায় গলায় ভাব। থাকতেন একই বিল্ডিংয়ে। তারপর কী যে হলো! ফাটল ধরল সম্পর্কে। পেশাদারিত্বের খাতিরে কদাচিৎ কথা ও দেখা হয় বটে, কিন্তু সেটি আর বন্ধুত্বের জায়গায় নয়। সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালে গল্পটা এমনই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই স্তম্ভের এই অবস্থান অবশ্য প্রকাশ্যে এনেছিলেন বিসিবি নাজমুল হোসেন পাপন। তারপর কথার কত ডালপালা ছড়াল। আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে নেতৃত্ব ছাড়লেন তামিম। দিলেন অবসরের ঘোষণা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ইউটার্ন নিয়ে গেলেন কয়েকমাসের বিরতিতে। তার অবর্তমানে ফের দায়িত্ব দেওয়া হলো সাকিবকে। সবাই ধরে নিয়েছিল, চোট কাটিয়ে ফেরা তামিমকে নিয়েই বিশ্বকাপে যাবেন সাকিব। হলো উল্টো। তামিমের কেন জায়গা হলো না সেটি এখন কমবেশি সবাই জানে। বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ার পর তামিম ফেসবুকে একটি লাইভ করেন। সেই বোমা বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা না যেতেই দেশের একটি টিভি চ্যানেলে দুই পর্বে তামিমকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেন সাকিব। দেশের ক্রিকেটও বিভক্ত হয়ে পড়ে দুই ভাগে। সাকিব কথা বলার একদিন পর গত ৫ নভেম্বর ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলতে ভারতে রওনা দেয় বাংলাদেশ দল। প্রথম ম্যাচ জিতলেও বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয় টাইগারদের। অনেকে মনে করেন, দুই সিনিয়র খেলোয়াড়ের এমন প্রকাশ্য বিরোধ প্রভাব ফেলেছে দলে।
শচীনকে ছাড়িয়ে কোহলি: মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে শচীন টেন্ডুলকারের মাঠ। এই মাঠেই বিশ্বকাপ জিতেছেন তিনি সেই মাঠেই যদি শৈশবের আইডল, ক্রিকেট ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়া হয় তবে এরচেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কী হতে পারে! বিরাট কোহলি সেটিই করেছেন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে ছাড়িয়ে যান শচীনকে। রেকর্ড ভাঙার পর আইডলকে মাথা নুয়ে সেলাম জানান ‘ক্রিকেটের কিং’। কোহলির ওয়ানডে সেঞ্চুরির সংখ্যা দাঁড়াল ৫০, শচীনের ৪৯। আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিতে অবশ্য ১০০ সেঞ্চুরির মালিক শচীনকে ছুঁতে আরও ২০ বার তিন অঙ্কের ঘরে পা রাখতে হবে কোহলিকে।
আবারও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া: এমন দাপটের সঙ্গে বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর কেউ ফাইনালে উঠেছে কিনা সন্দেহ। রাউন্ড রবিনের ৯ ম্যাচ ও সেমিফাইনাল মিলিয়ে অপরাজিত থাকা ভারত ফাইনালে কোনো লড়াই-ই দেখাতে পারেনি। পারবে কী করে! প্রতিপক্ষ যে অস্ট্রেলিয়া! ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল মানেই যাদের হলুদ উৎসব। সেই নাচন আরেকবার দেখা গেল ১৯ নভেম্বর ১ লাখের বেশি দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আহমেদাবাদেও নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে। কিন্তু ঘরের সমর্থকদের সামনে কান্নাই করতে হয়েছে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিদের। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ভারতকে কাঁদিয়েছিল অজিরা। ২০ বছর পর সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। একতরফা ফাইনাল জিতে সর্বোচ্চ ষষ্ঠ বার বিশ্বকাপ নিয়ে ঘরে ফেরেন প্যাট কামিন্সরা।
আফ্রিকায় জ্যোতিদের ইতিহাস: দক্ষিণ আফ্রিকাকে আগেই হারিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। তবে সেটি ঘরের মাটিতে। প্রোটিয়া মেয়েদের ওদের মাটিতে গিয়ে হারানোর যে স্বাদ সেটি এবারই প্রথম পেল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। বিজয়ের মাসে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারান নিগার সুলতান জ্যোতিরা। এরপর বিজয় দিবসের দিনে সেটিরই পুনরাবৃত্তি। প্রোটিয়া মেয়েদের প্রথম ওয়ানডেতে হারায় বাংলাদেশ। জ্যোতিরা এই জয় উৎসর্গ করেন মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের।
এশিয়ার রাজা বাংলার যুবারা: একে একে সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা ও সেমিফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা। দুবাইয়ের সেই ফাইনালে আবারও প্রতিপক্ষ আরব আমিরাত, যারা কিনা শেষ চারে হারিয়েছে পাকিস্তানকে। তবে এবারও আমিরাতকে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ। বিজয় দিবসের একদিন পর মাহফুজুর রহমান রাব্বির নেতৃত্বে প্রথমবার অনূর্ধ্ব ১৯ এশিয়া কাপও জিতল বাংলাদেশ যুবারা। ২০১৯ সালের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের। এবার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো আশিকুর রহমান শিবলির টুর্নামেন্ট জুড়ে অনবদ্য বোলিং ও মারুফ মৃধার দুর্দান্ত বোলিংয়ে। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হাত ধরে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবার এলো মহাদেশীয় মুকুট এশিয়া কাপ।
শান্তর নেতৃত্বে সিলেট টেস্ট জয়: বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চপাণ্ডবদের যুগ শেষ হওয়ার পথে। মাশরাফি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর না নিলেও দলে নেই ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে। অধিনায়ক সাকিব ব্যস্ত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। তামিম অবসর ভেঙে ফিরলেও নেই দলে। মাহমুদউল্লাহ অবসর নিয়েছেন টেস্ট থেকে। আছেন বাকি মুশফিক। পঞ্চপাণ্ডবের চারজনকে ছাড়াই নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বে ঘরের মাঠে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবার টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। মাশরাফি-সাকিবের পর বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে অধিনায়কত্বের অভিষেকেই জয়ের রেকর্ড গড়েছেন শান্ত। এখন পঞ্চপাণ্ডবদের ছাড়াই নতুন বাংলাদেশ দলের স্বপ্ন দেখছেন সবাই। সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত শান্ত-মিরাজরা।
ফন্টেইন-বেদির বিদায়: ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ ম্যারাডোনা। গত বছর ২৯ ডিসেম্বর পৃথিবীকে বিদায় জানান ‘ফুটবলের রাজা’ পেলে। তাদের হারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ফুটবল বিশ্ব। এ বছর ১ মার্চ চলে গেলেন আরেক ফুটবল কিংবদন্তি জাস্ট ফন্টেইন। ফ্রান্সের হয়ে যিনি এক বিশ্বকাপেই ৬ ম্যাচে ১৩ গোল করার অনন্য কীর্তি গড়েছিলেন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তার করা সেই কীর্তি অক্ষুণ্ন আছে এখনো। এ বছর ক্রীড়াবিশ্ব হারিয়েছে আরেক ক্রিকেট কিংবদন্তিকে। গত ২৩ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের সাবেক স্পিনার বিষেণ বেদি সিং। উপমহাদেশের এই স্পিন কিংবদন্তি এক সময় ছিলেন প্রতিপক্ষের জন্য সাক্ষাৎ যমদূত।
সবাইকে ছাড়িয়ে জোকোভিচ: সময় মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনার জন্ম দেয়, অবাক না হয়ে পারা যায় না। বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম খেলতে এক বছর আগে নোভাক জোকোভিচ অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছিলেন অনেক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকার করায় কোর্টেই নামা হয়নি তার। সার্বিয়ান তারকাকে আটক করে ঘরে ফেরত পাঠায় মেলবোর্নের পুলিশ। পরের বছর ফিরেই মেলবোর্নে লিখলেন ইতিহাস। রেকর্ড ১০ম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন। সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্লামে ছুঁয়ে ফেলেন রাফায়েল নাদালকেও। আর এখন জোকোর গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ২৪। চোটের কারণে লম্বা সময় ধরে কোর্টের বাইরে থাকা নাদালের সেই সংখ্যা ২২-এ থমকে আছে। জোকোভিচ ২০২৩ সালে ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ড স্লামের আশা জাগিয়েও পারেননি। উইম্বলডন জিতলে সেটি পূর্ণতা পেত। সেটি পারেননি নাদালেরই একাডেমির ছাত্র কার্লোস আলকারাজের কারণে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ