ফুটবল জনপ্রিয়তার জোয়ার: উন্নয়নের পথনকশা 

সালেক সুফী

প্রবাসে অনেকেই সঙ্গত কারণে প্রশ্ন করেন বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের মাঝে ফুটবলের জোয়ার থাকা সত্ত্বেও দেশটি কেন আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক ফুটবলে কেন তলানিতে? সম্প্রতি সমাপ্ত কাতার বিশ্বকাপ ধরুন , বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে, নগরে বন্দরে  ব্রাজিল আর্জেন্টিনা বন্দনা ফুটবল বিশ্বের নজর কেড়েছে। যেভাবে প্রিয় দল দুটি নিয়ে মাতামাতি করেছে বাংলাদেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতা তা খোদ ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সাধারণ জনগণকেও নাড়া দিয়েছে। এমন না যে বাংলাদেশ ফুটবলের ঐতিহ্য নেই বা অর্থ বা সামর্থের অভাব। ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্বে যুগের বেশি সময় ধরে আছেন বাংলাদেশ ফুটবলের কিংবদন্তি কাজী সালাহউদ্দিন।  সরকারি অনুদান বা স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্ভাবনার কমতি নেই। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে বিভিন্ন মাপের ,বিভিন্ন আয়োজনের খেলা হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় খাবি খাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন দল।  স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে কেন? তাহলে কি বাফুফে বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাব ? নাকি অবকাঠামোগত দুর্বলতা,  ক্লাব ফুটবলে নির্ভেজাল পেশাদারিত্বের কমতি।

আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশ অঞ্চলে ফুটবলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে। বাবা ছিলেন কলকাতার প্রখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফুটবল দলের অধিনায়ক। খেলেছেন গৌরবের সঙ্গে কলকাতা ফুটবল লিগে। বড় ভাইয়ের নিজের ফুটবল দল ছিল। আমি নিজেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খেলেছি। কিশোর বয়সে দেখেছি মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, ইপিআইডিসির দাপট। ওমর, মুসা, তোরাব আলী, কালা গফুর, আলী নেওয়াজ, জব্বারদের পাশাপাশি আশরাফ, কবির, মারি, নবী চৌধুরীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এশিয়া মানের ফুটবল উপভোগ করেছি।

১৯৬০ দশকের শেষ দিকে প্রতাপ, টিপু , পিন্টু, সান্টু, মেজর হাফিজ ভাইদের দেখেছি। বাংলাদেশের ফুটবল দল মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গড়ে মুক্তিযুদ্ধের ফুটবল দল গড়ে বিদেশের মাঠে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। স্বাধীনতার পর মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন দ্যুতি ছড়িয়েছে।  আমি নিজে বাংলাদেশ দলকে মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল ফুটবল দলকে হেসে খেলে জয় পেতে দেখেছি। সালাহউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু , চুন্নুদের পরে আসলাম, মোনেম মুন্না, সালাম, বাদল, সাব্বিরদের পর ক্রমে ক্রমে ফুটবল কেন হারিয়ে গেলো? কে দিবে জবাব?

এবারের বিশ্বকাপ থেকেই শিক্ষা নেওয়া যাক। সৌদি আরব, জাপান, মরক্কো  কেমন খেলেছে? ক্ষুদ্র দেশ ক্রোয়েশিয়া কিভাবে সেরাদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে খেলেছে? বেলজিয়াম কি বাংলাদেশ থেকে খুব বড়? এমনকি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার আর্থসামাজিক অবস্থা কি বাংলাদেশ থেকে অনেক উন্নত? কি জবাব আছে আমাদের?

দেখবেন ফুটবলের কৌশল, খেলার ধারা পাল্টে গেছে। ল্যাটিন মার্কিন ধ্রুপদী ফুটবলের পাশাপাশি নেদারল্যান্ড, স্পেনের তিকিতাকা ফুটবল আর ইউরোপের পাওয়ার ফুটবল রপ্ত করে ফেলেছে সব দল।  এবার দেখলাম অংশগ্রহণকারী ৩২ দলের মাঝে ব্যাবধান ঘুচে গেছে, বড় দল ছোট দল বলে কেউ নেই। ছোট দলগুলো মুহূর্তে ঝড় তুলে  লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে বিশ্বসেরাদের।  টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউকি ভেবেছিলো সৌদি আরব শুরুতেই চমকে দিবে মেসির আর্জেন্টিনাকে? ফ্রান্স কিভাবে হোঁচট খেলো তিউনিসিয়ার কাছে? কিভাবে মরক্কো একে একে বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগাল বাধা পেরিয়ে সেমি ফাইনালে পৌছালো? কেন জার্মানিকে নক আউট রাউন্ডের আগেই হেরে যেতে হলো? বাংলাদেশের ফুটবল বোদ্ধারা কি এগুলো দেখে কিছু শিক্ষা নিয়েছেন?

শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না। ইউরোপের দেশগুলিতে সত্যিকারের পেশাদার লীগ,  ক্লাবগুলোর বয়োসভিত্তিক দল, নিজস্ব একাডেমি, সকল পর্যায়ে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি শুধু ইউরোপ নয় ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার ফুটবল পাল্টে দিচ্ছে। এবারের বিশ্ব আসরে যারা ভালো খেলছে তাদের অধিকাংশ ইউরোপের লীগ সমূহের প্রতিষ্ঠিত বা উদীয়মান খেলোয়াড়।

আমি শুধু বাংলাদেশকেই বলছি না বলছি বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশকেই। এমন না যে এই সব দেশ ফুটবলে অর্থ ব্য়য করছে না। নামি দামি ফুটবল কোচ এমনকি শীর্ষ স্থানীয় ক্লাবগুলোতেও আনা  হচ্ছে, পেশাদার লীগ হচ্ছে।  কিন্তু ক্লাবগুলোর পেশাদারি অবকাঠামো নেই, অধিকাংশ ক্লাবের নিজেদের একডেমি নেই। তৃণমূল থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করে পর্যায়ক্রমে বিকাশের পরিকল্পনা নেই।

একসময়ের জনপ্রিয় দল মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ওয়ান্ডারার্স একসময় ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়িয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের ফুটবল জোয়ার সঠিক পথ নকশায় বিকশিত করে টেকসই উন্নয়নের পথযাত্রী করতে হলে ফুটবল প্রশাসনে কয়েকজন চ্যাম্পিয়ন প্রয়োজন। আটটি বিভাগ পর্যায়ে অন্তত আটটি ফুটবল উপকেন্দ্র গড়ে তোলা, স্বয়ংসম্পূর্ণ আটটি ফুটবল স্টেডিয়াম, একাডেমি স্থাপন। ক্রীড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমূহকে সমন্বিত পরিকল্পনায় ফুটবল উন্নয়ন। স্মরণে রাখবেন যত অর্থই বিনিয়োগ করা হোক না কেন একটি দুটি তিনটি বসুন্ধরা, সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব বাংলাদেশ ফুটবলের খোল নলচে পাল্টে দিবে না।

পরিশেষে বলি সঠিক ফুটবল দূতিয়ালি করলে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, স্পেন, জাপান, জার্মানি থেকেও ব্যাপক ফুটবল সহযোগিতার সুযোগ আছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 2 =