ফেরদৌস আহমেদ অভিনয় থেকে রাজনীতিবিদ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতার পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রথম পুরস্কার হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮) দ্বিতীয় পুরস্কার গঙ্গাযাত্রা (২০০৯) তৃতীয় পুরস্কার কুসুম কুসুম প্রেম (২০১১) ও চতুর্থ পুরস্কার এক কাপ চা (২০১৪)।

ফেরদৌস আহমেদ চলচ্চিত্র অভিনেতা। তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি মডেলিং ও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিভাগে অনার্স শেষ করেছেন। বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতেও তিনি বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। ফেরদৌস আহমেদের জন্ম ৭ জুন, ১৯৭৪ সাল। তিনি জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লায়। সিনেমায় প্রবেশ করেন প্রয়াত নৃত্য পরিচালক আমির হোসেনের হাত ধরে। ফেরদৌস এক সাক্ষাৎকারে জানান, ছাত্রজীবনে তিনি একবার বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি থেকে এফডিসিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এফডিসির ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়ার সময় হঠাৎ আমির হোসেন বাবু তার কাছে এসে বলেন ফেরদৌস অভিনয় করতে আগ্রহী কি না। প্রথমে তিনি রাজী না হলেও আমির হোসেন বাবুর অনুপ্রেরণায় কাজ করা শুরু করেন। প্রয়াত অভিনেতা শালমান শাহের মৃত্যুর কারণে তার অভিনীত অসমাপ্ত একটি সিনেমার ফেরদৌস অভিনয় করেন। এর মধ্য দিয়ে তার সিনেমার সাথে পথ চলা শুরু। সিনেমাটির নাম ছিল ‘বুকের ভিতর আগুন’। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। পরবর্তীতে তিনি একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করতে থাকেন।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমাতে অভিনয় করেন ফেরদৌস। সিনেমাটি পরিচালনা করেন বাসু চ্যাটার্জি। এই সিনেমাটি ভারত ও বাংলাদেশে ব্যবসাসফল একটি সিনেমা। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র মধ্যে দিয়ে ফেরদৌস পরিচিতি লাভ করেন। দর্শক তাকে নতুন করে উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ফেরদৌস জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে হূমায়ুন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’ সিনেমায় অভিনয় করেন। তার জীবনের বেশিরভাগ ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে ও সেসব সিনেমার কথা সবাই মনে রেখেছে। দক্ষ অভিনয় দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে তিনি সকলের প্রিয় অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন।

২০০৯ সালে ‘গঙ্গাযাত্রা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ২য় বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১০ সালে সাড়া জাগানো ‘গোলাপি এখন বিলাতে’ সিনেমায় অভিনয় করেন। ‘কুসুম কুসুম প্রেম’ সিনেমায় অভিনয় করে তিনি ৩য় বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১২ সালে ‘খোকাবাবু’ নামের ভারতীয় ছবিতে তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া ২০১২ সালে মুক্তি পায় ফেরদৌসের নিজের প্রযোজনায় ছবি ‘এক কাপ চা’। ২০১৬ সালে মেহের আফরোজ শাওনের পরিচালনায় ‘কৃষ্ণপক্ষ’ সিনেমায় অভিনয় করে ফেরদৌস ৪র্থ বার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। অভিনয় শুরু করার আগে তিনি র‌্যাম্প মডেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ডিজাইনার বিবি রাসেলের হাত ধরে তিনি মডেলিং জগতে পা রেখেছিলেন। এছাড়া তার অভিনীত আরো উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা হলো: চুপি চুপি, সবার উপরে প্রেম, বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, খায়রুন সুন্দরী, গেরিলা, প্রাণের মানুষ ইত্যাদি।

ফেরদৌস অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার পরিবারের সবাই রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাই ছোটবেলা থেকে রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অভিনয়ের মাধ্যমে যেমন তিনি সকলের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন, ঠিক তেমন করে রাজনীতির মাঠে সকলের ভালোবাসা কামনা করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি অভিনয় ও রাজনীতি দুজায়গাতেই সমানতালে কাজ করতে চান। তিনি বলেন, অভিনয়ের জন্যই আমি আজকের ফেরদৌস। তাই অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে বেছে বেছে কাজ করব। ফেরদৌস দেশাত্মবোধক সিনেমায় কাজ করতে খুব আগ্রহী, তিনি প্রচুর অনুদানের সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কারণ ভালো গল্প তাকে খুব বেশি টানে, অভিনয়ের ব্যাপারে তিনি খুব বেশি বাজেট নিয়েও ভাবেন না। গল্প পছন্দ হলে তিনি কাজ করেন।

অভিনয়, রাজনীতির বাইরে গিয়ে ফেরদৌস আহমেদ বইও লিখেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘এই কাহিনি সত্য নয়’। প্রকাশ করেছে প্রথমা। ২০২৩ সালের বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার সময়ের একটি ঘটনাকে ঘিরে তার এই বই। কিছুটা সত্য ও আর কল্পনা দিয়ে তিনি এই গল্প সাজিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই বই পড়ার পাশাপাশি লেখালেখির প্রতি তার আগ্রহ ছিল। কিন্তু লেখালেখি তেমন করে কখনোই হয়নি। প্রথমা প্রকাশনীর উৎসাহে তিনি বইটি লিখেন।

পঁচিশ বছর অভিনয়ের সাথে থেকে ফেরদৌস যখন পেছনে ফিরে তাকান তখন তার মনে হয় যেন খুব দ্রুত সময়গুলো চলে গেছে। তিনি নায়ক হয়ে সিনেমাতে পা দিয়েছেন, নায়ক হয়েই থাকতে চান। খুব বড় অভিনেতা হবার ইচ্ছে তার নেই, শুধু সময়কে আটকে রাখার তার খুব ইচ্ছা। কিন্তু সময়কে তো আটকে রাখা সম্ভব নয়। তবে তিনি মনে করেন, প্রতিটি বয়সের একটি আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। বয়স উপভোগ করা উচিত কারণ এই বয়সকে সাথে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। নিজের কাজের মাধ্যমে সকলের মাঝে বেঁচে থাকতে চান আজীবন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফেরদৌস প্রায় তার ছোটবেলা নিয়ে বেশ আক্ষেপ করেন। তিনি মনে করেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো তিনি ফেলে এসেছেন যা কখনই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে স্কুল, ছোটবেলার বন্ধু ও যেখানে শৈশবের দীর্ঘ সময় পার করেছেন সেসব জায়গার কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে, যা আর কখনোই তিনি আগের মতো পাবেন না। চলতি বছরেই ৪৯ পেরিয়ে ৫০ বছরে পা দিলেন তিনি। জন্মদিনে তার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাবার কথা। কারণ ছোটবেলায় বাবা তার জন্মদিন ঘিরে নানা ধরনের আয়োজন করতেন। বাবার কাছে তার থাকত অনেক ধরনের আবদার। বড়বেলার জীবনে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছে করা বায়নাগুলো।

২০০৪ সালে ৯ ডিসেম্বর ফেরদৌস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সহধর্মীনির নাম তানিয়া রেজা। তিনি পেশায় একজন পাইলট। ফেরদৌস জানান, তার সহধর্মীনি অনেক ক্যারিয়ার সচেতন, যা তাকে বেশ অনুপ্রাণিত করে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন হতে। তিনি আরো বলেন, তাদের দুজনের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ। সহধর্মীনির যেহেতু পাইলট তাই তার বিশাল বড় দায়িত্ব। স্ত্রী যখন নিজের দায়িত্ব পালন করতে যান তখন তিনি সন্তানদের দেখাশোনা করেন। ফেরদৌস দুই সন্তানের পিতা। সন্তানদের তিনি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, কিন্তু তাদের পেশা নিয়ে কখনো তারা চিন্তিত নন। কারণ তার সন্তানদের এমনভাবে তৈরি করে দিতে চান যাতে তারাই নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝতে পারে ও নিজেদের জন্য সঠিক পেশা বেছে নিতে পারে। ফেরদৌস ভ্রমণ করতে খুব ভালোবাসেন। অনেকগুলো দেশে তিনি ভ্রমণ করেছেন। তার প্রিয় শহর লন্ডন, তার ইচ্ছা করে বার বার লন্ডনে যেতে। তিনি রান্না করতেও পছন্দ করেন। এছাড়া মায়ের হাতের যেকোনো রান্না তিনি খেতে ভালোবাসেন। মুরগি দিয়ে খিচুড়ি ও খাসির কোরমা তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

ফেরদৌস নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ সচেতন। যেহেতু ক্যামেরার সামনে কাজ করতে হয় তাই নিজের ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা কমবেশি করতে হয়। তবে বয়সের কারণ ফিটনেস সবারই কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়, তবে তা চেষ্টার মাধ্যমে ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন ফেরদৌস। ফেরদৌস তার ঘুমের রুটিন ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। কারণ ঠিক মতো ঘুম না হলে চোখের নিচে কালি পড়ে যায় ও ত্বক সজীবতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়া চেষ্টা করেন ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে। শুটিংয়ের প্রয়োজনে তাকে মেকআপ নিতে হয় তবে তিনি চেষ্টা করেন খুব ভালো একটি টোনার দিয়ে নিজের মেকআপ তুলে ফেলতে। বেশিরভাগ পুরুষরাই নিজের ত্বক ও স্বাস্থ্যের অবহেলা করে, যা একদম ঠিক নয়। সবারই উচিত স্বাস্থ্যর প্রতি খেয়াল রাখা ও নিজের যত্ন নেওয়া।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 4 =