ফেরা হলো না সাকিবের

নিবিড় চৌধুরী

কিছু কিছু আশা অপূর্ণই থেকে যায়। সাকিব আল হাসান চেয়েছিলেন, দেশে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ খেলেই বিদায় জানাবেন টেস্ট ক্রিকেটকে। কিন্তু দেশ সেরা এই অলরাউন্ডারের সেই আশা অপূর্ণই থেকে গেল। বাধার মুখে মাঝপথেই থেমে যেতে হলো তাকে।

গত সেপ্টেম্বরে ভারতে কানপুর টেস্ট শুরুর আগে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তার শেষ হয়ে থাকল গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তবে টেস্ট থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন প্রোটিয়াদের বিপক্ষে খেলে। নিরাপত্তা ইস্যু বিবেচনা ও খতিয়ে দেখার পর টেম্বা বাভুমা-এইডেন মার্করামরাও এলেন ঢাকায়। তবে সাকিব আসতে পারলেন না। ভারত থেকে তিনি চলে গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে, পরিবারের কাছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সবুজ সংকেত পেয়ে সাকিব উড়াল দিয়েছিলেন দেশের পথে। তার আসার খবর পেয়ে পথে নামেন সাকিব-বিরোধীরা। নিরাপত্তা ইস্যুতে সাকিবকে থেমে যেতে হয় দুবাইয়ে। সাকিবের অপরাধ, তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর ছিলেন। ছিলেন মাগুরার সংসদ সদস্য। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি খেলতে কানাডায়। সে সময় গ্যালারিতে এক সমর্থকের প্রতিবাদে তার বলা ‘দেশের জন্য আপনি কি করেছেন’ কথাটি বেশ ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে তার স্ত্রী উম্মে শিশির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট করে ‘দারুণ দিন কাটল’ ক্যাপশনটি দিয়েও বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাকিবের নামে হয়েছে হত্যা মামলা। সেই মামলার কারণে দেশে ফেরা হলো না ৩৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডারের।

আদৌ কি ফিরতে তিনি পারবেন? ফিরলেও কি দেশের মাটিতে আর খেলতে দেখা যাবে সাকিবকে? সামনে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে তাকে দলে ভিড়িয়েছে চিটাগং কিংস। কিন্তু নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে গুঞ্জন, হয়তো বিপিএলেও খেলা হবে না তার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাকিবের খেলতে আসার কথা শুনে মিরপুরে বিক্ষোভ করেছে সাকিব-বিরোধীরা। রাস্তায় নেমেছিল সাকিব-পক্ষরাও। মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে দুই দলের মধ্যে হয়েছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। অনেকে আহতও হয়েছেন। পরিস্থিতি শান্ত করতে হয়েছে সেনাবাহিনীকে। সেই বিক্ষোভের মাঝেই মিরপুরে অনুশীলন সেরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান প্রোটিয়ারা।

সাকিববিহীন সিরিজের প্রথম টেস্টে বাজেভাবে হেরেছে বাংলাদেশ। অথচ এই সিরিজেই সতীর্থ ও প্রতিপক্ষদের থেকে ‘গার্ড অব অনার’ নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারতেন তিনি। কিন্তু আমাদের দেশের নোংরা রাজনীতি সেই সুযোগ কেড়ে নিল। একজন ক্রিকেটারের জন্য ‘সম্মুখসমর’ হতে দুনিয়া আগে দেখেছে কি? বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় কোন খেলোয়াড়কে দেখা গেছে একটি দেশের সংসদ নির্বাচিত হতে? সাকিবের কি দরকার ছিল রাজনীতি করার নাকি তাকে দরকার ছিল আমাদের পচে যাওয়া রাজনীতিতে। আজ সেই প্রশ্ন আসছে। ভবিষ্যতেও আসবে। খেলোয়াড় হিসেবে যথেষ্ট ক্ষমতাবান, বিত্তশালী, পরিচিতমুখ সাকিবের কেন প্রয়োজন হলো আরও অধিক কিছুর! সেই ক্ষমতা গ্রহণের সাত মাসের মাথায় উল্টো বুমেরাং হয়ে তাকে খেলো। দেশের মানুষের ভালোবাসা হারালেন। গালি শুনলেন। ক্যারিয়ারের শেষটা রাঙানোর যার কথা ছিল, তার মুখে লাগল চুনকালি।

দেশের ক্রিকেট তো বটে, বিশ্ব ক্রিকেটকেও অনেক কিছু দিয়েছেন সাকিব। ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও থাকবে তার নাম। সেই নাম মুছে ফেলা যাবে না। তার মতো বড় ক্রিকেটার আমাদের এসেছিল কবে! কিন্তু ‘চাঁদেরও যে কলঙ্ক’ আছে! সেই সত্য কীভাবে মুছবেন সাকিব! দগদগে ঘায়ের মতো কী সারাজীবন বয়ে বেড়াবেন না? দেশের মানুষ যদি ঘৃণা করে, তারচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। দেশের বাড়ি মাগুরায় সাকিবের বাবা-মা আছেন। আছে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যও। সেসব যে চোখেও দেখতে পারছেন না তিনি। সাকিব কি আরেকবার শৈশবের মতো হাঁটতে পারবেন তার প্রিয় জন্মভূমিতে! দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তিনি বিশাল স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু দেশের মানুষ যে তাকে ক্ষমা করতে পারেনি!

সাকিবের শেষের শুরু হয়েছে আগেই। ভারত সফরে জানিয়েছিলেন, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে বিদায়ের কথা। টেস্টের শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়নি। টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন গত বিশ্বকাপ দিয়ে। তবে ওয়ানডেতে এখনো আছেন তিনি। আগামী বছর পাকিস্তানে ‘মিনি বিশ্বকাপ’ নামে পরিচিত আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে একদিনের ক্রিকেটকেও বিদায় বলবেন সাকিব। এরপর হয়তো এখনকার মতো দেশবিদেশে খেলে যাবেন। কিন্তু তাতে কী মন ভরবে? দেশের মাঠের মতো আর কোথায় সমর্থকদের থেকে ‘সাকিব সাকিব’ আওয়াজ শুনতে পাবেন তিনি!

ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব সাকিবের অপূর্ণতা বলতে তেমন কিছুই নেই। দুই দশকের কাছাকাছিই তো মাঠে কাটালেন। কিন্তু দেশকে এনে দিতে পারেননি আইসিসি বা এশীয় কোনো ট্রফি। কয়েকবার ফাইনাল খেললেও বহুজাতি কোনো টুর্নামেন্টেও শিরোপা জেতা হয়নি। তারপরও সাকিব ছিলেন আমাদের কাছে, ‘গরীবের ঘরের চান্দের আলো’। তিনি ছিলেন বলেই বিশ্ব ক্রিকেটে অনেক সাফল্যের মালা গাঁথতে পেরেছে বাংলাদেশ। সাকিবের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ইংলিশ কন্ডিশনে ২ সেঞ্চুরিতে ৬০০+ রান ও ১১ উইকেট। তার নৈপুণ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল তিন জয়। কিন্তু আশা জাগিয়েও খেলতে পারেনি সেমিফাইনালে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সাকিবের বিতর্কিত অধ্যায় বেড়েছে। ভারতে গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের। তার আগে সাবেক বন্ধু তামিম ইকবালের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব, তাকে বাদ দেওয়া, বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগে আগেই টি-স্পোর্টসে সাকিবের ‘এক্সক্লুসিভ’ দুই পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার হয়ে উঠেছিল দেশ তো বটে বিশ্ব ক্রিকেটেরই আলোচনার বিষয়। ক্যারিয়ারে প্রায় সময় বিতর্কিত হয়েছেন সাকিব। আবার সাহস দেখিয়েও নাড়িয়ে দিয়েছেন অনেক কিছু। ঘরোয়া ক্রিকেটে কখনো মাঠে খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে ঝগড়া, আম্পায়ারের সামনে লাথি মেরে স্টাম্প ভাঙা, বিসিবির সভাপতি হতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ, তামিমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, নিদাহাস ট্রফিতে দলকে উঠে যেতে বলা, বিশ্বকাপে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’; এসব নিয়ে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন সাকিব। বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোনো খেলোয়াড় আছেন কি যিনি একই সঙ্গে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? এমন বর্ণিল জীবন আছেই বা কয়জনের!

সাকিব-ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রিকেটে ইতিমধ্যে ঘটে গেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে মেয়াদ বাকি থাকলেও বরখাস্ত হয়েছেন প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বিসিবির নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ আসার পর লঙ্কান কোচকে ছাঁটাইয়ের ইঙ্গিত অবশ্য আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। ভারত সফরে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতা, নাসুম আহমেদকে চড় মারার ঘটনা, দলের মধ্যে কোন্দল তৈরি, অনুমতি ছাড়া ছুটির কারণে হাথুরুকে বরখাস্ত করা হয়েছে জানিয়েছে বিসিবি। তবে সেটি নিয়ে একমত নন সাবেক কোচ। দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে এক বিশাল চিঠিও তিনি দিয়ে গেছেন বোর্ডকে। জানিয়েছেন পরবর্তীতে পাওনা আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।

এরই মধ্যে আরেকটি খবরে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়া। সমালোচনা ও চাপের মুখে মাত্র ৮ মাসের মাথায় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। অবশ্য চট্টগ্রাম টেস্টে তিনিই অধিনায়কত্ব করেছেন। শান্ত সরে গেলে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম। তবে কি নতুন নতুন অধিনায়ক পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ? মিরপুর টেস্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব-ইস্যুতে ‘প্রতিদিন একটি করে স্ট্যাটাস দেবেন’ বলে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন শান্ত। তার মধ্যে নিজের ব্যাটে রানও নেই। হয়তো নেতৃত্বের চাপে ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে পারছেন তিনি। কথিত পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে এখন শুধু টেস্ট খেলছেন মুশফিকুর রহিম। তিনি বিদায় নিলে একটি অধ্যায়েরও শেষ হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই দিন হয়তো খুব দূরে নয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six + twelve =