বঙ্গবন্ধুর গণ-উন্নয়ন পরিকল্পনার রূপরেখা

মুস্তাফা মাসুদ: বঞ্চনা-বৈষম্য-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত মেধা ও মননসমৃদ্ধ এক স্নিগ্ধ গণমুখী বাংলাদেশই ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের আরাধ্য স্বপ্ন; যার আকাঙ্ক্ষা বাঙালির হাজার বছরের। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই একাত্তরে তাঁর আহ্বান ও নিরঙ্কুশ প্রভাবে অগণিত মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া; ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান আর অগণিত মা-বোনসহ অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট ও ত্যাগস্বীকার।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। দেশে এসেই তিনি যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। গরিব-দুঃখী, সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের লক্ষ্যে সারাজীবন যে মধুর স্বপ্ন তিনি লালন করে এসেছেন বুকের গভীরে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আর নানা প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি কঠোর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকলেন।

কিন্তু দেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় শক্তহাতে, দ্রুততম সময়ে  দেশের নানামুখী সংকট-সমস্যা মোকাবিলা এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তসহ দেশের ভেতরের নানা নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী পাশ হয় এবং সংসদীয় সরকার-পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার-পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। সংসদের ওই অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে তাঁর সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেন এভাবে: ‘‘আজ শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।.. আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারী, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রি করতে হবে, এদের অধিকারের নামে আমাদের এদেরকে ফ্রি-স্টাইল ছেড়ে দিতে হবে? কক্ষনো না।..’’ [২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫: জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণের অংশ]

তিনি বুঝেছিলেন, দেশকে দ্রুত সংকটমুক্ত করে সত্যিকার ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করতে হলে এমন এক কার্যকর ব্যবস্থা চাই, যা ঘুণেধরা সমাজের খোলনলচে পাল্টে দিতে পারে; কৃষক-শ্রমিক তথা সাধারণ দুঃখী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়: ‘‘আজ আমি বলতে চাই This is our second revolution, second revolution আমাদের। এই revolution এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এর অর্থ অত্যাচার-অবিচার-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।.. যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি, এটাও গণতন্ত্র। শোষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা সমাজতন্ত্র করতে চাই। আমাদের শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই।’’ [১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণের অংশ]

বঙ্গবন্ধুর এই ‘নতুন সিস্টেম’ তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ছিলো প্রান্তিক জনগণের কল্যাণে গণমুখী প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা,  গণমুখী বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম-সমবায় ব্যবস্থা চালুর মাধমে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন, দুর্নীতির মূলোৎপাটন, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার সম্প্রসারণ, সর্বক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা অর্জন, পরনির্ভরশীলতা বর্জন ইত্যাদি।

শত শত বছর ধরে নানা অবিচার আর জুলুমের শিকার জনগগণের জন্য সহজে এবং দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিকেন্দ্রীকৃত গণমুখী প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যাতে অন্যায়-অপরাধসহ নানামুখী বিশৃঙ্খলা কঠোর হস্তে দমন করা যায় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। বিচার পেতে গিয়ে যাতে মানুষের হয়রানির শিকার হতে না হয়; বিচার পাওয়ার আশায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে না হয়। এ প্রসংঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার।.. এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে যে, থানায় ট্রাইব্যুনাল করার চেষ্টা করছি এবং সেখানে মানুষ এক বা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পাবে তার বন্দোবস্ত করছি।’’

বাংলাদেশ মূলতই কৃষিপ্রধান দেশ বলে তিনি কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এবং সমবায়ের ভিত্তিতে সমস্ত কৃষিজমি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘‘গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। পাঁচ বছরের প্ল্যান এই বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে।.. প্রত্যকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে।’’ (ঐ)

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-পরিকল্পনায় ছিলো বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল, মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা; গ্রাম-শহরের উন্নয়ন-অবকাঠামোর মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য নিরসন করা। এজন্য তাঁর দ্বিধাহীন উচ্চারণ: ‘‘ভিক্ষুক জাতির কোনো ইজ্জত নাই।.. একটা জাতি যখন ভিক্ষুক হয়, মানুষের কাছে হাত পাতে, আমারে খাবার দাও, আমারে টাকা দাও- সেই জাতির ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি সেই ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।… আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে জাতি হিসেবে।’’

উল্লিখিত কর্মসূচিসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর আজীবনের স্বপ্ন শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত প্রস্তুতি-পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঐ বছরের (১৯৭৫) ১লা সেপ্টেম্বর থেকেই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিসমূহ সরকারিভাবে বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ বঙ্গবন্ধু আর পেলেন না।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট খুনিচক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে বহু আগেই বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, কৃষি-ব্যবস্থা ও খাদ্য উৎপাদনসহ আর্থসামাজিক সকল ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হতো এবং জনগণের ভাগ্যের প্রত্যাশিত পরিবর্তন হতো- এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।

কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য, জাতির পিতা যখন তাঁর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করেছেন; সমগ্র জাতিকে এই নতুন বিপ্লবের প্রাণবন্ত আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, তখনই ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্টরা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাতের অন্ধকারে। যারা চায়নি বাংলাদেশ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করুক নিজের পায়ে দাঁড়াক, সফল হোক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সোনালি আকাঙ্ক্ষা আর মুজিবের আজীবনের ‘সোনার বাংলা’র সবুজ-শ্যামল স্বপ্ন-প্রত্যাশা, সেই ভয়ঙ্কর পিশাচেরা আর সময় দিতে চাইল না তাঁকে। সপরিবারে, নিরস্ত্র অবস্থায় তাঁকে খুন করল তারা। ফলে অমিত সম্ভাবনাময় একটি স্বপ্নের গোলাপকুঁড়ি চোখ মেলবার আগেই দানবের পদপিষ্ট হয়ে হারিয়ে গেল চিরতরে; এক ক্লান্তিহীন অভিযাত্রীর পথচলা থেমে গেলো তাঁর কাঙ্ক্ষিত মন্জিলে পৌঁছার আগেই!

আজ যারা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের সমালোচনা করেন, তারা হয়তো নিছক বিরোধিতার জন্যই তা করেন। এর যুগান্তকারী গণমুখী কর্মসূচি তথা গণ-উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর যে ক’টি বক্তব্য এ নিবন্ধে তুলে ধরেছি, তা কি কোনো ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী শাসকের, না কৃষক-শ্রমিক, শোষিত-বঞ্চিত জনগণের বন্ধু এক মহান দরদি জননেতার? তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে কি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য হৃদয়-নিঙড়ানো মমত্ববোধ আর উদ্বেগ ঝরে পড়েনি? এমন খাঁটি দেশপ্রেমিক, জনদরদি মানুষের কোনো কর্মসূচি কি জনস্বার্থবিরোধী হতে পারে?

আসলে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর উদার-প্রশস্ত বৈপ্লবিক কাঠামোর মধ্যে দেশকে সত্যিকার জনগণমুখী ‘সোনার বাংলা’ তথা শোষণ-বঞ্চনাহীন সুখের আবাস হিসেবে গড়ে তোলার মূল সূত্র বিদ্যমান ছিলো- একথা আজ স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই।

আজ বঙ্গবন্ধু নেই। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে অম্লান গরিমায়। তাঁর আজন্ম লালিত দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন আজ নানা বৈভবে বিকশিত-পল্লবিত হচ্ছে কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার সমার্থক হয়ে। পিতার দেশপ্রেম, সাহস, দেশের মানুষের জন্য নিখাদ মমত্ববোধ, দূরদর্শিতা, ন্যায়কে ন্যায় বলা আর অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎসাহস, সর্বোপরি এক আদর্শ দেশনায়কে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে জনগণের স্বপ্ন-প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। বঙ্গন্ধুর প্রিয় ‘আমার মানুষ’ আজ তাঁর কন্যারও বড়ো আপনজন। তাঁদের জন্যই তাঁর সার্বক্ষণিক ভাবনা আর কর্ম-প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গৃহীত শেখ হাসিনার কর্মসূচিগুলোর দিকে তাকালে তার পরতে পরতে জাতির পিতার স্বর্ণালি স্বপ্নের ছায়া আমরা দেখতে পাই। আর এভাবেই একদিন বঙ্গবন্ধু-লালিত শোষণ-বঞ্চনাহীন গণমানুষের ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। শেখ হাসিনা সফল হোন; তাহলে সফল হবে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কষ্ট-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ; নতুনতর মহিমায় দীপ্তিমান হবে পঁচাত্তরের রক্তদান!

 পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × one =