আফরোজা নাইচ রিমা
বঙ্গবন্ধু এবং শান্তি আন্দোলন এক ও অবিচ্ছেদ্য। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। একই বছর অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস’। ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন শান্তি সম্মেলনে,যেখানে তাঁর কথা বলা বা মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। চীন ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে শান্তি সম্মেলনের অমোঘ দলিল হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে আছে বর্তমানেও।
১৯৫৬ সালের ৫-৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
বঙ্গবন্ধুর সরকারের দৃঢ় অবস্থান ছিল কোনো সামরিক জোটে যোগ না দেয়া। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’
বর্তমানে ২০২৩ সালে এসেওজাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্যদের সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি ২০২২ সালের জন্য জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সক্ষমতার প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা বাংলাদেশে ‘পিস বিল্ডিং সেন্টার’-এর সঙ্গে দুই প্রধানমন্ত্রী শান্তি সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছেন। উভয় নেতাই পারমাণবিক অস্ত্রহীন বিশ্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।এছাড়া, সাম্প্রতিককালে মায়ানমার,ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত এবং সংকটমূলক পরিস্হিতি থেকে উওরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর ‘ যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই’ অপরিহার্য এবং সময়োপযোগী সমাধান।
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশ্বের ১৪০ দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবরের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখাগুলোর বহু প্রতিনিধি এই সভায় যোগ দেন। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’
জুলিও কুরি পুরস্কার গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিরোধ করে ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তির অপরিহার্যতা। এই পটভূমিতে আপনারা- বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে ‘জুলি ও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন। এই সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানিদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। আমরা জানি, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সে জন্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনিবিসাউসহ দুনিয়ার সব উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইলকর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সব স্থানের বর্ণবাদী নীতির। জয় বাংলা। জয় বিশ্বশান্তি।’
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের মাধ্যমে সারা বিশ্বে একটি শান্তিপ্রিয় ও ন্যয়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ও সংগঠনকে বিশেষ অবদানের জন্য ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি বিশ্বে প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী। তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার জন্য দুবার দুটি শাখায় নোবেল পুরস্কার পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তার গড়ে তোলা ২২০টি রেডিওলজি স্টেশনে প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহতের এক্স-রে করানো হয়। তার এই অসাধারণ অবদানকে অমর করে রাখতে ১৯৫০ সাল থেকে ‘জুলিও কুরি’ বিশ্ব শান্তি পদক প্রবর্তন করা হয়। বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’ পদক। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাই এ পুরস্কার পেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু; কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো; চিলির প্রথম কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে; ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের নেতা, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওর চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত; দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা এবং দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা; সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী চিলির কবি, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা; ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী এবং সমাজ সমালোচক বার্ট্রান্ড রাসেল; গোয়ের্নিকা খ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, কিউবিজম পদ্ধতির স্রষ্টা, ভাস্কর, কবি এবং নাট্যকার পাবলো পিকাসো; তুরস্কের মহান বিপ্লবী, খ্যাতিমান কবি নাজিম হিকমত; বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার চার্লি চ্যাপলিন; আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিংসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা। ১৯৫০ সালে প্রথম যাদের এই পুরস্কার দেওয়া হয় তাদের একজন হলেন চেকোস্লোভাকিয়ার সাংবাদিক, সমালোচক ও লেখক জুলিয়াস ফুচিক।
সত্তরের দশকে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনির মুক্তিকামী মানুষের নেতা ইয়াসির আরাফাত, চিলির নির্যাতিত মানুষের নেতা সালভাদর আলেন্দে, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হোচি মিন, সোভিয়েত রাশিয়ার নেতা লিউনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে উচ্চারিত হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। উল্লেখ্য, কলকাতায় ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোককেই উদ্ধার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। চীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু চীন সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনি, আপনার সরকার ও জনগণ আমাকে ও আমার দলের সদস্যদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং আমাকে আপনাদের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিয়ে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলিনি। আমি আপনাদের উন্নতি কামনা করি। নিজের দেশে যে নীতি আপনারা গ্রহণ করেছেন, আশা করি অন্য দেশে অন্য নীতি গ্রহণ করবেন না। (কারাগারের রোজনামচা ১৩৪ ও ১৩৫ পৃষ্ঠা)।একই সাথে জাতিসংঘ, “Our Common Global Agenda” ২০৩০ এজেন্ডায় পারস্পরিক নির্ভরশীল সম্পর্কের স্বীকৃতি দেয়, যেখানে টেকসই উন্নয়ন এবং শান্তি অপরিহার্য।একটি ছাড়া অন্যটি অর্জন করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলি ও কুরি শান্তি পুরস্কারের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বর্তমান বৈশ্বিক বিবেচনায় শান্তির জন্য পৃথিবী’র অবিনাশী এক ইতিহাস রচনা করে গেছেন । বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কারের ৫০ বছরে আজো তা প্রতিধ্বনিত হয়।
লেখক: উপ-প্রকল্প পরিচালক, তথ্য অধিদফতর,বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।