বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শন ও গ্রামভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা

হরিদাস ঠাকুর: বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন দেশের প্রতিটি গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করা হবে। তিনি গণমুখী সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সমবায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যে কত গভীরে প্রোথিত ছিল এবং কত সুদূরপ্রসারীত চিন্তাসমৃদ্ধ তা লক্ষ্য করা যায় ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে প্রদত্ত তার বক্তব্যের মধ্যে। উক্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন: বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন, ধ্যান, ধারণা ও আরাধনার ধন। আর সে সোনার বাংলা ঘুমিয়ে আছে চির অবহেলিত গ্রামের আনাচে কানাচে, চির উপেক্ষিত পল্লীর কন্দরে কন্দরে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির আশেপাশে আর সুবিশাল অরণ্যের গভীরে। ভাইয়েরা আমার-আসুন সমবায়ের যাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি। নব-সৃষ্টির উন্মাদনায় আর জীবনের জয়গানে তাকে মুখরিত করি। আমাদের সংঘবদ্ধ জনশক্তির সমবেত প্রচেষ্টায় গতে তুলতে হবে ‘সোনার বাংলা’। এ দায়িত্ব সমগ্র জাতির, প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের এবং তাদের প্রতিনিধিদের। তবেই আমার স্বপ্ন সার্থক হবে, সার্থক হবে শহিদের আত্মত্যাগ, সার্থক হবে মাতার অশ্রু। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার সত্যিকারের অর্থ খুজে পাবে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদে, আপামর জনসাধারণের ভাগ্যান্নয়নে । তবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে রূপায়িত হবে সমাজতান্ত্রিক নীতির এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবো সমবায়ের মাধ্যমে। জয় বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলন। জয় বাংলা।

দেশজ উন্নয়ন ছিল বঙ্গবন্ধুর একান্ত ভাবনা। কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পকে তিনি সমবায় ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সাধারণ নির্বাচনের আগে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বেতার টেলিভিশন ভাষণ থেকে আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর সমবায় চিন্তা। তিনি বলেন ‘‘ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে উৎসাহ দিতে হবে। কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁতীদের ন্যায্যমূল্যে সূতা ও রং সরবরাহ করতে হবে। তাঁদের জন্যে অবশ্যই বাজারজাতকরণ ও ঋণ দানের সুবিধা করে দিতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে এসব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সুষ্টি হয়।’’ ছোটো ছোটো চাষিদের কথাও তিনি বিস্মৃত হননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষ্যে বেতার-টেলিভিশনে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ছোটো ছোটো চাষিদের অবশ্যই উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। এ কথা মনে রেখে আমরা পল্লী এলাকায় সমবায় ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। এর ফলে চাষিরা কেবল আধুনিক ব্যবস্থার সুফলই পাবে না বরং সমবায়ের মাধ্যমে সহজশর্তে ও দ্রুত ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে।’’

বঙ্গবন্ধু জানতেন শুধু উৎপাদন করলেই চলবে না ও সংশিষ্ট অন্যান্য ব্যবস্থাও সুসংহত হয়না। প্রয়োজন রয়েছে সুষম বন্টন ও সরবাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রেও তিনি সমবায় ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর প্রয়াস নেন।  ১ মে ১৯৭২ সালে শ্রমিক দিবস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে তিনি তাই বলেন:

আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তন করেছি। পাশাপাশি দুঃখী জনগণের অভাব মোচন ও দুর্দশা লাঘবের জন্য আমাদের সাধ্যমত আশু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা ও পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ করা হয়েছে। লবণ উৎপাদনকে আর আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। সরকার প্রায় ষোল কোটি টাকার টেস্ট রিলিফ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছে। দরিদ্র চাষিদের দশ কোটি টাকার তাকাবি ঋণ, এক লক্ষ নব্বই হাজার টন সার, দু’লাখ মণ বীজ ধান দেওয়া হয়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে চার কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। তিনি আরো বলেন ‘‘আমাদের সমগ্র পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে রয়েছে বন্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা। ইতিমধ্যেই বেসরকারি ডিলার, এজেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সকল সকলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, যদি তারা অসাধু ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করে তাহলে তাদের সকল লাইসেন্স-পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রতি ইউনিয়নে ও সমস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সমবায় ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে বেসরকারি ব্যক্তিদের বন্টনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সাময়িক স্বল্পতার সুযোগে যুক্তিহীন মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ হবে।

বঙ্গবন্ধু সমবায়কে দেখতেন নতুন সমাজ-আদর্শ সমাজ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে। তিনি দুর্নীতির কথা জানতেন-দুর্নীতিবাজদের কথা জানতেন-সমাজের পচনের কথা উপলব্ধি করতেন। এর থেকে মুক্তির জন্য তিনি সমবায় পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাইতো ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণাকালে বলেছিলেন :

আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্লাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হোর্ড করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। …সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘৃণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। …আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ এদিন থাকবে না।…আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুল প্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে।

বঙ্গবন্ধু বাংলার উন্নয়নে গ্রামে গ্রামে গ্রাম সমবায় গড়তে চেয়েছিলেন। গ্রাম সমবায় ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের সোপান রচনা করতে চেয়েছিলেন গ্রাম সমবায়ের সফল বাস্তবায়নের দ্বারা। গ্রাম সমবায় গঠনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে তার ছিল স্পষ্ট দর্শন ও মনোভাব। গ্রাম সমবায়ের রূপরেখা তিনি স্পষ্টভাবে এঁকেছিলেন। এ বিষয়ে এক গভীর অন্তদৃষ্টি আমরা তাঁর বক্তব্য থেকেই পাই:

কো-অপারেটিভও আমি প্রতিটি গ্রামে করতে চাই। এটা সোজাসুজি বাঙালি কো-অপারেটিভ। যাকে বলা হয় মালটিপারপাস কো-অপারেটিভ। কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্ট আছে, থাক। ওটা চলুক। আমি এটার নাম দিয়েছি স্পেশাল কো-অপারেটিভ। …কাজের জন্য আসতে হবে ময়দানে। আপনাদের কাজ করে শিখতে হবে। সেই জন্য আমার কো-অপারেটিভ। যদি কাজ করে শিখতে চান, যদি ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে না চান, তাহলে আমার কো-অপারেটিভ সাকসেসফুল করুন। বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শন এবং দ্বিতীয় বিপ্লব-এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হন। একে তিনি  This is our second revolution বা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন।  ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা প্রমুখকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল নামে একটি জাতীয় দল গঠন করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সর্বোচ্চ জাতীয় ঐক্য অর্জন। এ জাতীয় দলের ১৫টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ: [ছয়: সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমান্বয়ে যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ প্রচলন।]

দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে দুটি দিক ছিল-(ক) সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্মসূচি এবং (খ) আর্থসামাজিক কর্মসূচি। (ক) প্রথমত ছিল সরকার-পদ্ধতির পরিবর্তন, একটি জাতীয় দল গঠন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করা, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে জনগণের প্রতিনিধি বা গভর্নর, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং (খ) দ্বিতীয়ত সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ও ভূমিব্যবস্থাপনা, গ্রামে মাল্টিপারপাস বা বহুমুখি কো-অপারেটিভস, পল্লী অঞ্চলে ‘হেলথ কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠা, পরিকল্পিত পরিবার এবং শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচিতে ৫টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। এগুলো হলো: দুর্নীতি উচ্ছেদ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যি নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এবং জাতীয় ঐক্য।

দ্বিতীয় বিপ্লবের আওতায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছিলেন যার অন্যতম ছিল সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ। এসব পদক্ষেপগুলো হলো: জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ; প্রতিটি থানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ; পর্যায়ক্রমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ; কৃষকদের নিকট ফার্টিলাইজার পৌঁছানো; খাল কেটে কৃষি জমিতে চাষের ব্যবস্থা। পাম্প সরবরাহ না করা পর্যন্ত বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে কিংবা কুয়া কেটে সেখান থেকে কৃষিকার্যে পানির ব্যবস্থা করা; কৃষির ক্রমান্বয়ে যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষি ও শিল্পের প্রসার। উৎপাদন ও বন্টন প্রক্রিয়ায় কৃষক ও শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা; সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ। জমির মালিকানা থাকবে এবং কিছুতেই নেওয়া হবে না, বঙ্গবন্ধু  স্পষ্ট তা জানিয়ে দেন। উৎপাদিত ফসলের এক অংশ জমির মালিক, একভাগ কৃষক ও এক অংশ সরকার পাবে। সমবায় হবে কম্পালসারি; গ্রামে[গ্রামে ৫০০ থেকে ১০০০ পরিবার নিয়ে মাল্টিপারপাস ভিলেজ কো-অপারেটিভ, ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে ৫ বছরে ১টি করে এরূপ বহুমুখী সমবায় স্থাপন। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি কর্মক্ষম মানুষ এর সদস্য হবে। সরকারের কাছ থেকে অর্থ, ফার্টিলাইজার, টেস্ট রিলিফের বরাদ্দ, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের বরাদ্দ তাদের কাছে যাবে। কৃষি সমবায়ের মতো এর উৎপাদিত পণ্যও জমির মালিক, কো-অপারেটিভের সদস্য ও সরকারের মধ্যে বন্টিত হবে। এরপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য,‘আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা টাউট আছে, তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে।’

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের বাজেটে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বেশকিছু অগ্রগতি সাধিত হয়। এর মধ্যে সমবায় সেক্টরের অর্জন ছিল নিম্নরূপ:  ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা তাকাতি ঋণ কৃষি ব্যাংক ও সমবায়ের মাধ্যমে ১৯ কোটি ২১ লক্ষ টাকা কৃষি ঋণ দেওয়া হয় এবং পাবনা ও ঢাকার সমবায় দুগ্ধ উৎপাদন কেন্দ্রের একত্রীকরণ ও সম্প্রসারণের অগ্রগতি সমবায় কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

বঙ্গবন্ধু এমন সমবায়ের কথা ভেবেছেন যা গ্রামের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করবে, শুধু কৃষি- উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতের নয়। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর সমবায় ছিল ‘বহুমুখি’ সমবায়। বিভিন্নমুখি তৎপরতা পরিচালনাও এসব সমবায়ের লক্ষ্য ছিল। তিনি গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় তথা গ্রামের বাইরের সব সম্পদও গ্রাম সমবায়ের মাধ্যমে ও প্রবাহিত করার কথা ভেবেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সমবায়ী গ্রাম প্রস্তাবের পেছনে একদিকে ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং অন্যদিকে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। বঙ্গবন্ধু নিজে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর সময়কালে আন্তর্জাতিক পরিণ্ডলে সমাজতন্ত্রের যে মডেল বিরাজমান ছিল, তাতে কৃষিতে যৌথচাষভিত্তিক সমবায়কেই যথাযথ বলে বিবেচনা করা হতো। দ্বিতীয় বিপ্লব এবং তার অংশ হিসেবে সমবায়ী গ্রাম কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব বিবেচনা থেকেই বের করেছিলেন।

গ্রামের বিপুল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে একমাত্র সমবায়কে অবলম্বন হিসেবে বঙ্গবন্ধু চিহ্নিত করেন। তিনি দরিদ্র ও অশিক্ষিতদের উন্নয়নের স্বপ্ন বিনির্মাণে সমবায়ের শক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেখান, সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে অনেকের পুঁজির সমন্বয়ে বৃহৎ বিনিয়োগ সম্ভব, যা সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। দুভার্গ্যবশত পূঁজির স্বার্থান্বেষী চক্র, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট, দেশি বিদেশি চক্র ‘দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের’ বঙ্গবন্ধুর তত্ত্ব বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। তা নাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনমান আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে গর্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতো।

বঙ্গবন্ধুর ‘সমতাবাদী বহুমুখি সমবায় গ্রাম’ এর রূপরেখা বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী মহাচিন্তক। তিনি সময়ের অগ্রগামী পুরুষ ছিলেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমরা অবাক বিস্ময়ে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা উপলব্ধি করতে পারি। বর্তমানের জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত খাদ্য চাহিদা, কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা ও কৃষি যান্ত্রিকীকিকরণ, অব্যবহৃত পতিত কৃষি জমি উৎপাদনের বাইরে পড়ে থাকা-এসব সমস্যার কথা আগেই বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু ‘গ্রাম সমবায় সমিতি’র পরিকল্পনা করেছিলেন। এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বর্তমানের অনেক সমস্যার উদ্ভব হতো না বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

গ্রামের আর্থসামাজিক চিত্রে আমূল পরিবর্তন আনাই ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনার নির্যাস। আধা সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থার অবসান বা কৃষিক্ষেত্রে শোষণকে উৎপাটিত করার লক্ষ্যে- স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য, সকল কর্মক্ষম গ্রামীণ জনতার সমবেত শ্রমশক্তিকে উৎপাদনক্ষেত্রে বিনিয়োজিত করে এবং উৎপাদন উপকরণসমূহকে পূর্ণভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত করে গ্রাম বাংলার দরিদ্র দীন দূঃখী শোষিত কৃষক জনতার মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ‘‘বাধ্যতামূলক বহুমূখী গ্রাম সমবায়’’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর গ্রামভিত্তিক সমবায় আন্দোলনের বর্তমান উপযোগিতা বঙ্গবন্ধু প্রবর্র্তিত ‘বাধ্যতামূলক বহুমূখী গ্রাম সমবায়’ কর্মসূচি ছিল একটি যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এটি ছিল একটি সময় উপযোগী (Time Driven ), চাহিদা উপযোগী ( Demand Dreven ) ও পরিস্থিতি বা আবহ উপযোগীতার (Situatuon Driven) নিরিখে উন্নয়নমূখী ও জনমূখী (Pro-development and Pro-people ) চিন্তার আলোকে জনবান্ধব (Pro-people) কর্মযজ্ঞ।  উক্ত কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা তথা সামগ্রিক আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন আসতো। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য যে সব ইতিবাচক ফলাফল আমরা পেতে পারতাম তার কয়েকটি হলো: গ্রাম সমবায় কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সমবায় এলাকার সকল কৃষিজমি সমবায়ের উপর ন্যস্ত হতো। সমবায় এলাকার সকল সাবালক কৃষক-কৃষাণী সমবায়ের সদস্য হতে পারতো এবং সকলে মিলে চাষাবাদ করতো। এ পদ্ধতিতে বর্গা প্রথা, মজদুর প্রথা উঠে যেতো। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রম প্রদানের জন্য সকলকে একদিকে যেমন পারিশ্রমিক দেওয়া হতো, অপরদিকে উৎপাদিত ফসল সমান তিনভাগে জমির মালিকবৃন্দ, কৃষি শ্রমিক বা ভূমিহীন ও সমবায় বা সরকারের মাঝে সমানভাগে ভাগ করা হতো। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব শুরু হতো এবং এর ফলে ব্যাপক জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন হতো। ফসলের উদ্বৃতাংশ বিদেশে রপ্তানি করে কৃষি ও শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করে দেশকে শিল্পায়িত করা সহজতর হতো। দেশ অনেক আগেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো। বিধিবদ্ধ পূঁজিতে বেসরকারি উদ্যোগে বা ব্যক্তি মালিকানায় ছোটোখাটো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা ও আভ্যন্তরীণ ব্যাবসাবাণিজ্যকে উৎসাহ প্রদান করা হতো। ব্যক্তি মালিকানা যাতে তাদের শ্রমিকৃবন্দ ও দ্রব্যসামগ্রীর ক্রেতা সাধারনকে শোষণ করতে না পারে, সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। গ্রাম সমবায়ই হতো প্রশাসনের প্রাথমিক ও মূল ভিত্তি। গ্রাম সমবায়ের সার্বিক ক্ষমতা থাকতো জনসাধারণের উপর। এর ফলে নেতৃত্বের বিকাশসহ জনগণের ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হতো। ভূমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হতো। ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়তো। (একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় পাকিস্তান আমলে এদেশের কৃষকের খণ্ডিত বিভিন্ন জমিতে যে পরিমাণ আইল ছিল তার পরিমাণ যোগ করলে তৎকালীন বগুড়া জেলার আয়তনের সমান হতো। এ চিত্র বর্তমানে পাল্টেনি। বরং আরো প্রকট হয়েছে জমির বিভক্তির ফলে।) শুধু উৎপাদন নয়; বরং বন্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়ও ইতিবাচক এবং গুণগত পরিবর্তন আসতো।

লেখক: উপসচিব ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 2 =