ইরানী বিশ্বাস
জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন সেমিনার, প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না এসব আয়োজনকারীদের অধিকাংশই সুযোগসন্ধানী। বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বৈধ কমিটি বা উপকমিটির বাইরেও প্রায় তিন শতাধিক কমিটি রয়েছে। তাদের নামের সঙ্গে রয়েছে বঙ্গবন্ধু।
বেশ কিছুদিন আগে ডকুমেন্টরির কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে কাজ করতে হয়েছিল। সে সময়ে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে পরিচয়ের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। পরিচয়ের প্রথমেই তিনি জানালেন তিনি ‘বঙ্গবন্ধু ডুবুরি লীগ’র প্রেসিডেন্ট। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কতোটুকু জানেন? তার মুখের অবয়ব দেখে বুঝতে দেরি হলো না, আমাকে তিনি পছন্দ করছেন না।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৫২ সালে সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান এবং এক বছর পর দলের সাধারণ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে এই মর্মে সমঝোতা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ধারাবহিকতায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ পুনর্গঠন করা হয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট-সরকার গঠন করলে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে সরকার গঠন করতে বাধাগ্রস্ত হয় আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হয় আন্দোলন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর গ্রেপ্তারের আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে শেখ মুজিব যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিলেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তার জের ধরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
আমার কাছে ‘রাজনীতি’ শব্দটির অর্থ রাজ-নীতি অর্থাৎ রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করেন যে বা যিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু ডুবুরি লীগ বা চাকরিজীবী লীগ নয় বঙ্গবন্ধু চাবিওয়ালা সংগঠন, রিকশা লীগ, বঙ্গবন্ধু রিকশা মালিক সমিতি, মুজিব সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু হকার্স সমিতি, বঙ্গবন্ধু মাছ ব্যবসায়ী সমিতি এমন আরো অনেক সংগঠনই চোখে পড়ছে আজকাল। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে নিবন্ধন ছাড়াও ৩ শতাধিক লীগ যুক্ত সংগঠন সক্রিয় রয়েছে দেশে। চারিদিকে এত দল, তাহলে জনতার কাতারে বোধ করি আর কেউ নেই।
রাজনীতি এখন বাংলাদেশের মানুষের জন্য আবশ্যিক বিষয় হয়ে গেছে। বিষয়টা এমন, যেন দল না করলে তাকে সভ্য মানুষ মনে করা হয় না! খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক কি কারণে এবং কবে থেকে দেশের মানুষ এতো রাজনীতি সচেতন হয়েছে। সময়ের ঘেরাটোপে অনেক সময় গড়িয়েছে। একসময় দেখা গেল দেশের প্রতিটি মানুষ এখন এক একজন রাজনীতিবিদ। প্রত্যেকেই রাজনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রত্যেকেই প্রেসিডেন্ট, প্রত্যেকেই ভবিষ্যতের দেশনায়ক! সকলেই নিজেকে এক একজন ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনা হিসেবে কল্পনা করেন। কেন এমন হলো?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনারেবল পলিটিশিয়ান থাকেন। তাদের কোনো একটা রাজনৈতিক দলে সম্মানজনক পদ বা পদবী প্রদান করা হয়। অথচ দেশের সংস্কৃতকর্মীরা রাজনৈতিক দলে নাম লেখাচ্ছেন। এসব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগণ সংস্কৃতি চর্চা ছেড়ে রাজনীতিতে বেশি মনোনিবেশ করছেন। কোনো দেশের শিল্প যখন রাজনৈতিক মাপকঠিতে ব্যবচ্ছেদ হয়, তখন তা আর শিল্প থাকে না। অতীতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভয় পেত। কারণ নাটক, সিনেমা বা সাহিত্যের মাধ্যমে দেশের অনিয়ম তুলে ধরা হতো। তাইতো শিল্পকে একটি দেশের আয়না বলা হয়।
বর্তমান সময়ে কিছু অসৎ মেধাহীন কবি-ছড়াকারগণ দেশ-দশের মঙ্গলে লেখা বাদ দিয়ে নিজের আখের গুছাতে ব্যস্ত। মিলাদ বা চল্লিশা যে কোনো প্রোগ্রামের আগে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, শেখ মুজিব ইত্যাদি নাম যুক্ত করা হচ্ছে। সাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী সব একই অবস্থা। শুধু তা-ই নয় শিল্প-কারখানার মালিক কর-ট্যাক্সের ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ছেন। কখনো কখনো নিজেই বঙ্গবন্ধুর নামে ফাউন্ডেশন গড়ে তুলছেন। ডাক্তারগণ চিকিৎসা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি ব্যস্ত। শিক্ষকগণ শিক্ষায় মনোযোগ না দিয়ে রাজনৈকিত কর্মকাণ্ড করছেন। চারিদিকে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে যেকোনো উপায়ে স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া।
গ্রাম্য পর্যায়ে রাজনীতির কুফল ঢুকে গেছে। অতীতে গ্রামের সাধারণ মানুষ গ্রাম্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতো। এখন সেটা দলীয় পর্যায়ে হয়। একটি গ্রামের সাধারণ মানুুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে কাকে দরকার শুধুমাত্র সেই গ্রামের মানুষের জানার কথা। এখন দলীয় লোকজন এসি রুমে বসে গ্রাম্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন। এখানে রাজনীতি যুক্ত হওয়ার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলাম না।
সুযোগসন্ধানী কিছু স্বার্থান্বেসী মানুষ সুযোগ বুঝে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে বাণিজ্য করছে। এসব মানুষই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য নষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিন শতাধিক নাম সর্বস্ব দল গঠন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। এই ভুইফোঁড় অঙ্গ সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, জাতীয় দিবসগুলো পালন করার জন্য চাঁদাবাজি করা হয়। সাধারণ মানুষ যারা কোনো রাজনীতির মধ্যে নেই, তেমন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষজন এসব ভুঁইফোঁড়দের চাঁদাবাজির ভয়ে তটস্ত থাকে।
বঙ্গবন্ধু উপাধি পেতে শেখ মুজিবকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছে। বাংলার সিংহপুরুষ শেখ মুজিবের হুংকারে পাকিস্তানি অপশক্তি পরাজিত হয়েছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, জাতির পিতা এতো সহজ বিষয় নয়; যে কেউ চাইলে তাঁর নাম ব্যবহার করতে পারে। অথচ বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর আদর্শে গঠিত আওয়ামী লীগ নিয়ে চারিদিকে মেকি উৎসবের হিড়িক লেগে গেছে। রাস্তা ঘাটে যে কেউ, যে কোনো অনুষ্ঠানের নামের আগে-পরে বঙ্গবন্ধুকে জুড়ে দিচ্ছে। সহজলভ্য মুড়ি মাখার মতো রাস্তায় রাস্তায় দোকান খুলে বসেছে। এতে জাতির পিতার অবমাননা হচ্ছে।
আপনাদের বলছি, যারা দলের বিশেষ পদ ও পদবীতে বসে আছেন; আপনারা দল করে পদ ও পদবী পেয়েছেন। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে মুজিব কোট পরে দল করে না, নিভৃতে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর দলের আদর্শ লালন করে; বিনিময়ে কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করেই। তাদের বিশ্বাস এবং আদর্শকে এভাবে ক্ষুণ্ন হতে দিতে পারেন না। প্লিজ আপনারা ঘুম থেকে উঠুন। প্রতিরোধ করুন বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে অবৈধ সংগঠন-প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ