বড়দিন নিয়ে অজানা কিছু তথ্য

০১। বছরের শেষ সপ্তাহে একদল মানুষ গেয়ে উঠে ক্রিসমাস ক্যারল। ২৫ ডিসেম্বর দিনটা এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিশেষ দিন। কারণ দিনটি যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিবস। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন বা ক্রিসমাস কথাটি এসেছে ‘মাস অফ ক্রাইস্ট’ থেকে। মূলত এই মাসের সময়সীমা সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে, তাই প্রার্থনা শুরু হয় রাত ১২টা থেকে। সেই থেকে ক্রিসমাস পালন শুরু হয়। খ্রিস্টান ধর্মপ্রধান পোপ জুলিয়াস গ্রেগেরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন হিসেবে পালনের ঘোষণা করেন।

০২। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে ২৫ শে মার্চ মেরি একটি দৈববাণী পান যে তার কোল আলো করে এক আশ্চর্য শিশু জন্মাবে। দৈববাণী হচ্ছে দেবতার বাণী। ২৫ শে মার্চের নয় মাস পর ২৫ শে ডিসেম্বর একজন মহামানব জন্ম নেয়। সেখান থেকেই ক্রিসমাসের যাত্রা শুরু।

০৩। প্রাচীন প্রবাদ আছে, ২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিন ঘোষণার আরও একটি তাৎপর্য হলো ওই সময় প্রাচীন উৎসব উইন্টার সলস্টিস পালন করা হয়। প্রতি বছর ২২শে ডিসেম্বর এই উৎসব পালন করা হয়। অনেকে এই দিনটাকে বছরের সবচেয়ে ছোট দিনও বলে থাকে। প্যাগান ধর্ম অনুসারীরা শীত উৎসব হিসেবে ‘স্যাটারনালিয়া’ নামক এক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত স্যাটরনালিয়া প্রাচীন রোমান উৎসব যা কৃষ্ণ দেবতা শনিকে সম্মান করে পালন করা হয়। উইন্টার সলস্টিসের কিছু প্রথা পরে ক্রিসমাস ক্যারোলে যুক্ত করা হয়।

০৪। ক্রিসমাস ট্রি’র কথা বলতেই হয়। প্যাগান সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করতেন ফার ট্রি বসন্তের আগমন ঘোষণা করে। আবার রোমানরা ফার গাছ সাজাতেন শস্য ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। তালিন, এস্তোনিয়া, রিগা আর ল্যাটভিয়া ক্রিসমাস ট্রির জন্য প্রসিদ্ধ৷

০৫। ক্রিসমাস ট্রি-তে তারা আর আলোর প্রচলন শুরু করেন মার্টিন লুথার কিং। একদিন তিনি রাতে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার ধারে ফার গাছের সারির মাঝ থেকে আকাশে অজস্র তারার অপার্থিব দৃশ্য দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে ফার গাছে জ্বলন্ত মোমবাতি লাগান।

০৬। বড়দিনের সঙ্গে ‘ফার’ গাছের একটা বিরাট সংযোগ রয়েছে। মূলত ‘ফার’ গাছে আলোকসজ্জা করে রঙিন করা হয় শহরের অলিগলি। ‘ফার’ অ্যাবিস গোত্রের উদ্ভিদের সাধারণ নাম। গাছের উচ্চতা ১০ থেকে ৮০ মিটারের মধ্যে হয়। পাতা আসিকুলার, সবুজ বা নীলাভ সবুজ রঙের হয়। সারাবিশ্বে ক্রিসমাস উদ্ভিদ হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এই উদ্ভিদটি।

০৭। বাইবেল অনুসারে, হাজার হাজার বছর আগে উত্তর ইউরোপে প্রথম ক্রিসমাস ট্রি’র প্রথা শুরু হয়। এই প্রতীকী গাছকে সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মানা হতো। বিশ্বাস করা হয়, চিরসবুজ দেবদারু জাতীয় এই গাছ বাড়িতে সাজালে অশুভ শক্তির বিনাস ঘটে। সেই থেকেই বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা শুরু হয়।

০৮। ক্রিসমাস ট্রি’র শীর্ষে লাগানো হয় ঝলমলে উজ্জ্বল তারা। এই তারাটি বেথলেহেমের উজ্জ্বল নক্ষত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। যিশুর জন্মের সময় তিন ম্যাজাই (জ্যোতিষী) কে আস্তাবলে পৌঁছানোর জন্য গাইড করেছিল আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা।

০৯। ক্রিসমাস ট্রি চারটি রঙ সজ্জিত থাকে। লাল, সবুজ, রূপালি এবং সোনালী। কেন বিশেষ এই রং? সবুজ গাছপালা এবং অন্যান্য উদ্ভিদ ঈশ্বর আমাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সৃষ্টি করেন। লাল যা যিশুখ্রিষ্টের রক্তের প্রতীক। রূপালি এবং সোনালি সমৃদ্ধ ও আশীর্বাদের প্রতীক। এছাড়া বৃত্তাকার আকৃতির ঝকঝকে বল ব্যবহার করা হয় যা মূলত স্বর্গসুখের রত্নের প্রতীক। ক্রিসমাস বল’কে ইতিবাচক আত্মার প্রতীক হিসেবেও মানা হয়।

১০। বয়স্ক বুড়ো সান্টা দাদুর নাম শোনেনি এমন শিশু নেই বলেই চলে। ছোটোদের বড়দিন মানেই পরনে লাল রঙের পোশাকের সান্টাক্লজ যারা মাথায় লাল টুপি, চোখে চশমা ও এক গুচ্ছ সাদা দাঁড়ি। শিশুদের কল্পনা ২৪শে ডিসেম্বর মধ্যরাতে তিনি থলে ভর্তি করে উপহার নিয়ে আসেন তাদের জন্য পৃথিবীতে। শিশুরা মনে করে তিনি সকল ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন। তুরস্কের পাতারা নামক অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তিনি মূলত একজন সন্ন্যাসী। তাঁর অন্য নাম সেন্ট নিকোলাস। ২৮০ খ্রীষ্টাব্দে তার আবির্ভাব ঘটে। জনমানুষের কাছে পবিত্রতা ও উদারতার জন্য তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন।তিনি সমস্ত অর্থ ব্যয় করতেন গরিব মানুষদের সাহায্য করার জন্য। বলা হয়, অসহায় মানুষদের সহায়তার জন্য তিনি দেশে দেশে ভ্রমণ করতেন। জীবিত অবস্থায় ২৪শে ডিসেম্বর গভীর রাতে ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের উপহার দেওয়ার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন।

১১। ২০০৯ এর এক ক্রিসমাস ইভে মাইক নামে জনৈক ব্যক্তির স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা হলে, মাইক তাকে পাশের নার্সিংহােমে ভর্তি করেন। বাচ্চার শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ হতে থাকে। মাইকের কোলে যখন বাচ্চাটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সেই সময় ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ আলােয় ভরে ওঠে চারপাশ আর বাচ্চাটির দেহে আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে আসে।

১২। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল মানব সমাজের এক অন্ধকার সময়। অনুমান করা হয় ১৭ থেকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ এই সময় মারা গিয়েছিল। যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মধ্যেও ১৯১৪ সালে ক্রিসমাসে মানব ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের অনুপ্রেরণায় এক ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়।

১৩। হ্যাটবক্স বেবি ১৯৩৩ সালের ক্রিসমাস ইভে এড এবং জুলিয়া স্টুয়ার্ট বাড়ি ফেরার পথে এক হ্যাটবক্সের ভেতর ফুটফুটে বাচ্চাকে পেলেন। তাঁরা তাকে দত্তক নিয়ে নিলেন। বাচ্চার শরীর একদম সুস্থ ছিল। ক্রিসমাস ইভে পাওয়া বলে সেই বাচ্চা হ্যাটবক্স বেবি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৪। ইংরেজি খ্রিস্টমাস (ঈযৎরংঃসধং) শব্দটি খ্রিস্টের মাস (উৎসব) শব্দবন্ধটির যুগ্ম অর্থ থেকে উৎসারিত। শব্দটির ব্যুৎপত্তি ঘটে মধ্য ইংরেজি ঈযৎরংঃবসধংংব ও আদি ইংরেজি ঈৎরংঃবং ‘সুংংব’ শব্দ থেকে। ১০৩৮ সালের একটি রচনায় শব্দটির প্রাচীনতম ব্যবহার দেখা যায়। “ঈৎরংঃবং” শব্দটি আবার গ্রিক ঈযৎরংঃড়ং এবং “সুংংব” শব্দটি লাতিন সরংংধ (পবিত্র উৎসব) শব্দ থেকে এসেছে।প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Χ (চি) হল ঈযৎরংঃ বা খ্রিষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। এই অক্ষরটি লাতিন অক্ষর ঢ-এর সমরূপ। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তাই এই অক্ষরটি খ্রিষ্ট শব্দের নামসংক্ষেপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। এই কারণে খ্রিষ্টমাসের নামসংক্ষেপ হিসেবে এক্সমাস কথাটি চালু হয়। আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব উৎসবটিকে বাংলায় বড়দিন আখ্যা দেওয়ার কারণটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোটো হতে আরম্ভ করে এজন্য বড়দিন দেওয়া হয়েছে।

১৫। ১৮৮১ সালে থামস নামে একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবিতে, সান্তার আটটি বলগা হরিণটানা সেøজ গাড়ি চড়ে বাচ্চাদের বাড়ি গিয়ে উপহার দেওয়ার চিত্র ফুটে ওঠে। এই ছবিটি গোটা বিশ্বে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে। তার থলিতে থাকত বাচ্চাদের জন্য আলাদা আলাদা উপহার। শান্ত শিশুদের জন্য থাকত চকলেট, খেলনা আরও চমৎকার সব উপহার। পাশাপাশি দুষ্ট বাচ্চাদের জন্য থাকত কয়লার টুকরো।

১৬। ক্রিসমাসের সময় হ্যাপি নয় বরং মেরি ক্রিসমাস বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। কিন্তু এর কারণটা কী? তবে ক্রিসমাসের আগে হ্যাপি বলা পুরোপুরি বাদ যায়নি। এখনও ইংল্যান্ডে ব্যাপকভাবেই ক্রিসমাসের আগে হ্যাপি ক্রিসমাস বলা হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য পাদ্রিরা হ্যাপির বদলে ক্রিসমাসের আগে মেরি বসিয়ে দেন। তারপর থেকে রক্ষণশীল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাই হ্যাপি ক্রিসমাস বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে ক্রিসমাস কার্ড, কিংবা উপহারে মেরি ক্রিসমাস লেখা ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ পেরিয়ে গোটা বিশ্বজুড়ে মেরি ক্রিসমাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৭। বড়দিনকে পৌত্তলিক (চবমধহ) উৎসব হিসাবে বিবেচনা করা হত। ১৮৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে উৎসব হিসাবে গণ্য করা হয়। তারপর ১৮৭০ সালে এই দিনটি সরকারী ছুটিতে পরিণত হয়।

১৮। কেরালার চেঙ্গানুরের বাসিন্দারা একটি বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছিলেন। বিশ্বের বৃহত্তম মানব ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করেছিলেন তারা। ক্রিসমাস ট্রি তৈরিতে ৪,০৩০ জন অংশ নিয়েছিল।

১৯। কানাডার মুস্কোকা গ্রামকে বলা হয় সকলের প্রিয় সান্তা ক্লজের বাড়ি। সেখানে সান্তার নামে একটি মেইলিং ঠিকানা রয়েছে। যেখানে আজও লক্ষ লক্ষ চিঠি পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিনল্যান্ডের ইন্ডিয়ানা, জর্জিয়া এবং অ্যারিজোনাতে সান্তা ক্লজ নামে বেশ কয়েকটি শহর রয়েছে।

২০। ইতিহাসের সর্বাধিক রেকর্ড করা ক্রিসমাস গান বলা হয় ‘সাইলেন্ট নাইট’ শিরোনামের গানকে। বর্তমানে গানটি সাতশোর অধিক ভিন্ন ভার্সন রয়েছে। ২০১১ সালে ইইনেস্কো গানটিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। গানটি প্রথম ১৯০৫ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten + fifteen =