বদলে যাওয়া বাংলাদেশে তিন মাসের ব্যস্ত সফর

সালেক সুফী

তৃতীয় পর্ব

বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর মিশনে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে অবাধ দুর্নীতি নির্মূল, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। পাচার কৃত অর্থ সম্পদ ফিরিয়ে আনা।

সদ্য শেষ হওয়া তিন মাসের বাংলাদেশ সফরকালে রিকশাওয়ালা, উবার চালক, সড়ক পাশে সবজি বিক্রেতা, টং ঘরের চায়ের দোকানি, পার্কে প্রাতঃভ্রমণ শেষে আড্ডায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, মেট্রোযাত্রী সরকারি, বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা, সাংবাদিক বন্ধু, খেলার মাঠের সাথী, আত্মীয় পরিজনদের সাথে কথা বলে জেনেছি সর্বস্তরে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে প্রধান বাধা।

অনেকেই মনে করে সরকার প্রধানের ঘোষণা মতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে মেগা প্রকল্পগুলো থেকে শুরু করে সাধারণ উন্নয়ন কাজগুলো অনেক কম খরচে সম্পাদন করা সম্ভব ছিল। উন্নয়নের সুফলগুলো আরো অধিক গভীরভাবে সর্বসাধারণের কাজে লাগতো। দুর্নীতির কারণে ব্যাঙ্ক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোতে তারল্য সংকট, সরকারি দপ্তরগুলো তহবিল শূন্য, মুদ্রাস্ফীতি চরমে। সমাজ জুড়ে লুটেরা শ্রেণির কারণে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।

দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীরা এলিট শ্রেণি সৃষ্টি করে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।  ক্ষমতাকে ঘিরে রাখা শ্রেণিটি দেশ থেকে মুদ্রা এবং সম্পদ পাচার করেছে বাধাহীনভাবে। অনেকের মতে দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। কমিশনের মাঝারি সারির একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করার পর তাকে কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকুরিচ্যূত করা হয়েছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানি বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, শুল্ক, পরিবেশ, স্বরাষ্ট্র, আইন বিচার, রেল, বিমান, এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই যেখানে দুর্নীতির কালো থাবা বিস্তৃত হয়নি। বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়ে গেছে দেশ থেকে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটদের হাত ধরে।  অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে এবং সরকারকে ঝুঁকি নিতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন থাকতে হলে তৃণমূল থেকেই সূচনা করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই শিশুদের সততা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েই সমাজসচেতন করে তুলতে হবে। সরকারকে সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তৃণমূল থেকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিকে ঘৃণা এবং দুর্নীতিবাজদের সমাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। মিডিয়ার সহায়তায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে। কাজগুলো কিন্তু সহজ না। সকল পর্যায়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা গেলে ধীরে ধীরে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।

১৫ বছর একাধারে সরকার পরিচালনার পর আবারো নতুন করে সরকার গঠন করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের বিরোধী দলের রাজনীতি মোটামুটি নিষ্ক্রিয়, সরকার প্রধান বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সহজেই সবকিছু জানতে বুঝতে পারেন। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট সফলভাবে মোকাবিলার জন্য সরকার প্রধানকে নির্মোহভাবেই দুর্নীতি নির্মূল করার অভিযান শুরু করতে হবে।

সেটি শুরু হওয়া উচিত তার উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদ সদস্যগণদের ঘিরেই। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের এক্টিভিস্টস, সিন্ডিকেটস নিয়ন্ত্রিত হলেই দুর্নীতি ৫০% কমে আসবে। তবে এগুলো করতে হবে পর্যায়ক্রমে কৌশলে। প্রতি ক্ষেত্রে চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকতে হবে।  আমি মনে করি বর্তমান সরকারের জন্য বিরোধী রাজনীতি কোনো চিন্তার বিষয় না। দুর্নীতি নির্মূল এখন সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

দ্রুত সময়ে দুর্নীতি দমনে কার্যকরী সাফল্য ছাড়া সরকারের স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। বিশ্বাস করি সরকার প্রধানের কাছে সব তথ্য আছে। বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক, আম জনতা দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে সুবিধাবাদী আমলা, কামলা, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেট হয়তো ৫% মানুষ। এদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজন সর্বস্তরে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা। আশা করি সরকার দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই পথে হাঁটবে। নাহয় বিফলে যাবে সব উন্নয়নযজ্ঞ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 4 =