বর্ষা মৌসুমে ঘুরে আসুন

হাসান নীল

বর্ষা মানেই ঝুম বৃষ্টি, মেঘেদের ছোটাছুটি, আকাশের সাথে মাটির জলজ মিলন। প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয় ঋতু এটি। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছেও বেশ পছন্দের এ মৌসুম। শহরের নর্দমার নোংরা জলে মাখামাখি রাস্তায় গা ঘিনঘিন করা সময় না কাটিয়ে এই সময় ব্যাকপ্যাক নিয়ে অনেকেই ছোটেন শহর থেকে দূরে। বন্ধুবান্ধব বা পরিজন নিয়ে মনের মতো করে কিছুটা সময় পার করতে। ভাবছেন কোথায় যাবেন বর্ষা মৌসুমে। দেশের ভেতর বেশকিছু জায়গা রয়েছে যা বর্ষাকালে ভ্রমণ উপযোগী। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন।

সুন্দরবন

প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবন। কদিন আগেও ঘূর্ণিঝড় রেমালের হাত থেকে এই বদ্বীপকে রক্ষায় বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন। শুধু দেশকে নিরাপদ রাখতে ঢাল হিসেবেই পরিচিত না বনটি। সৌন্দর্যের দিক থেকেও যেন ফুল হয়ে ফুটে আছে বাংলাদেশের বুকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই অপার প্রাচুর্যের কারণে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে বনটি। ভ্রমণপিপাসুদের  কাছেও এই ম্যানগ্রোভ বন ভীষণভাবে আকর্ষণীয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন এখানে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যান অপরূপ সৌন্দর্যে সাজানো এই বনে। সবুজ মখমল বিছানো এই বনজুড়ে রয়েছে ছোট ছোট দ্বীপ। বর্ষায় জলরাশি ফুলেফেঁপে ঘিরে ধরে দ্বীপগুলো। সবুজের সাথে জলের কলকল মিলে এক অপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সূর্যাস্তের সময় গলা জলে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলোর সৌন্দর্য বিমোহিত করে পর্যটকদের। বর্ষাকাল উপভোগ করতে সুন্দরবনের বিকল্প নেই। যেতে হলে খুলনা থেকে নৌপথে যাওয়াটাই উত্তম। বর্ষায় থৈ থৈ জলের দুপাশের গ্রামবাংলার দৃশ্য যেন শিল্পীর ক্যানভাসের মতোই সুন্দর। জলের বুকে নাউ ভাসিয়ে এই সৌন্দর্যের বুক চিরে গন্তব্যে যাওয়ার আবেদন অন্যরকম। এছাড়া বনের ভেতর পরিদর্শনের জন্য রয়েছে মোটরচালিত লঞ্চ। সেগুলোতে ভেসে অন্যদের সাথে উপভোগ করতে পারেন বর্ষা ভেজা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চাইলে স্পিডবোট ভাড়া করেও বনের সৌন্দর্য ঘুরে দেখতে পারেন।

জাফলং

স্রষ্টা যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছেন সিলেটের প্রতিটি অঞ্চলে। কোথাও রয়েছে চা বাগান, কোথাও ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা, কোথাও ঝরনা তাদের সৌন্দর্য মেলে আছে। এগুলোর একটি সিলেটের জাফলং। সৌন্দর্যের রানী বললেও ভুল হবে না। জাফলংয়ের এই ঝরনার উৎপত্তি ভারতের ডাউকি নদী থেকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপারেই নদীটির অবস্থান। যেটি পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জাফলংয়ের বুক চিরে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাতই জাফলংয়ের সৌন্দর্যের মূল উৎস। প্রতিদিন এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হন অসংখ্য পর্যটক। জাফলংয়ের বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়িয়ে ভারতের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি দেখা যায়। এসব পাহাড় থেকেই নেমে আসে জলপ্রপাত। বর্ষাকালে জাফলংয়ের সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এ সময় ভারী বৃষ্টির কারণে ডাউকি হয়ে ওঠে আরও অপরূপ। স্বচ্ছ জল যেন জাফলংকে আরও রূপসী করে তোলে। ডাউকির স্বচ্ছ পানি যেন দুচোখ ভরিয়ে দেয় পর্যটকদের। এছাড়া, ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।

শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার

সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মনমুগ্ধকর অঞ্চল। বর্ষাকালে বারবার এই পুণ্যভূমিতে ফিরে এলেও একঘেয়েমি ভর করবে না। একই অঞ্চলে বর্ষাকে উপভোগ করার মতো একাধিক অঞ্চল রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। এই উপজেলাকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। অসংখ্য চা বাগান এবং সাত রঙের চায়ের উৎপত্তির কারণেই এমন নামকরণ হয়েছে। বর্ষা এলে সবুজ চা বাগানগুলো আরও সতেজ হয়ে ওঠে। বৃষ্টির শব্দ আর শীতল পরিবেশে অন্যরকম এক সৌন্দর্য ধরা দেয়। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে শ্রীমঙ্গল মৌলভীবাজার ভ্রমণ অন্য সময়ের চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক। সেইসঙ্গে রয়েছে লাউয়াছড়া উদ্যান এবং মাধবপুর লেক। মাধবপুর লেক থেকে ধোলাই সীমান্ত পর্যন্ত পথের দুপাশ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাবে সারি সারি চা বাগান।

বিছানাকান্দি

ঘুরে আসতে পারেন বিছানাকান্দি থেকেও। বন্ধু বান্ধব বা পরিবার পরিজন নিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত স্থান। সিলেটের অন্য অঞ্চলগুলোর মতো বিছানাকান্দিতেও বিছানো আছে সৌন্দর্যের চাদর। আষাঢ় শ্রাবণে তা যেন আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের মতো সিলেটের বিছানাকান্দিতেও বর্ষা মৌসুমে ফুল ফোটে। এসময় মেঘালয়ের সেভেন সিস্টার থেকে নেমে আসে ঢল। যা ছড়িয়ে পড়ে বিছানাকান্দির নদীতে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড় থেকে নেমে আসা জল যেন পাহাড় নদীকে মিলিয়ে দেয়। বিছানাকান্দিতে মাথা উঁচিয়ে আছে খাসিয়া পর্বতগুলো। উচ্চতায় প্রমাণ সাইজের এই পর্বতগুলোর চূড়া থেকে মেঘ ছুঁয়ে দেওয়া যায় অবলীলায়। বর্ষাকালে সেভেন সিস্টার থেকে নেমে আসা পানির স্রোত যখন বয়ে চলা পিয়াইন নদীকে আলিঙ্গন করে তখন তাদের সৌন্দর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে চারদিক। বিছানাকান্দি যেতে প্রথমে যেতে হবে হাদারপুর। সেখানে ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকায় চেপে বসলে সহজেই যেতে পারবেন বিছানাকান্দি।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত

বর্ষায় সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রকন্যা হিসেবে পরিচিত এ সৈকতের বিশেষত্ব হলো বাংলাদেশের এই একমাত্র জায়গা থেকেই সূর্যাস্ত ও সূর্যদয় দুটোই দেখা যায়। ১৮ কিলোমিটারের পুরোটা জুড়েই সৌন্দর্য ছড়ান। মুহূর্তেই মুগ্ধ করে তোলে পর্যটকদের। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিবন্দি একঘেয়ে সময় না কাটিয়ে চলে যাওয়া যেতে পারে কুয়াকাটায়। সৈকত দেখে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি আপনার মন ভালো করে দিতে সেখানে আছে ৩৬ ফুট লম্বা সোনার বৌদ্ধ মূর্তি, শুঁটকি পল্লী, ফাতরার চর, লাল কাঁকড়ার দ্বীপ এবং মনোমুগ্ধকর মায়ামী গঙ্গামতির চর। সেইসঙ্গে যে কুয়ার নামে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে কুয়াকাটা, সে কুয়াটিও দেখে নিতে পারেন।

নীলাচল, বান্দরবন

বর্ষায় বন্ধু বান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে দূরে কোথাও ভ্রমণে যেতে চাইলে পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন বান্দরবনের নীলাচলকে। সমুদ্র ও পাহাড় মিলেমিশে রয়েছে যেখানে। সেইসঙ্গে রয়েছে পাখির কিচিরিমিচির গান। বর্ষার ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে জমবে ভালো। পাহাড়ের গায়ে বাস করা উদ্ভিদরাজির ভেজা গা কিংবা জলজ বাতাস আপনার অবসরকে করে দেবে উপভোগ্য। এরসঙ্গে সাগরের গর্জন আপনার কাক্সিক্ষত আনন্দ ছুঁয়ে দেখার নিশ্চয়তা দেবে। নীলাচলে ভ্রমণের সুবিধা হচ্ছে এখানে ছোট বড় বেশকিছু রেস্ট হাউজ আছে। আছে শিশুদের খেলার জায়গা। ফলে নীলাচলে বর্ষা বিলাস মোটেও ভুল সিদ্ধান্ত হবে না আপনার জন্য।

রাতারগুল

বর্ষায় ভ্রমণের জন্য আরও একটি উপযোগী স্থান রাতারগুল। বর্ষাকালে রাতারগুল মেলে ধরে তার আসল সৌন্দর্য। এ সময় বন সংলগ্ন গোয়াইন নদী প্লাবিত হয় ভারত থেকে আসা বন্যার পানিতে। ফলে জল ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বনের গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে গলা পানিতে। এটাই রাতারগুলের স্বর্গীয় সৌন্দর্য। এ সময় গাছের মাথা ছুঁয়ে নদী পার হওয়ার সময় পাখির ডাক খুব কাছে থেকে শোনা যায়। আর ডুবে যাওয়া গাছগুলোকে মনে হয় একেকটা ছাতা। রাতারগুলের এই সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে বর্ষাকালেই যেতে হবে। অন্য সময় গেলে প্রকৃতির এই রূপ চোখে পড়বে না। রাতারগুল ঘোরার জন্য রয়েছে শ্রীঙ্গি ব্রিজ। এছাড়া গোয়াইনঘাট বাজার থেকে ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। যা দিয়ে অনায়াসে সময়টা উপভোগ্য করে তোলা যায়।

কক্সবাজার

সাধারণত শীত মৌসুমে পর্যটকের ঢল নামে কক্সবাজারে। এই সময়ের বাইরে খুব কম মানুষই সেখানে যান। ফলে অধিকাংশ পর্যটকেরই দেখা হয় না বর্ষাকালীন কক্সবাজারের রূপ। মেঘ বৃষ্টিতে ভেজা বর্ষাকালে সাগর যেন অন্যরকমভাবে নিজেকে মেলে ধরে। সৈকতের সামনে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশি এবং উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ; এই রূপ যে দেখেনি সে নিখাদ সৌন্দর্য বলে যদি কিছু থাকে তা মিস করেছে। সেইসঙ্গে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের রূপ আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই শীতকালের পাশাপাশি বর্ষাকালে একবার হলেও কক্সবাজার যাওয়া উচিত। স্নান, সূর্যস্নান, সাঁতার কাটা এবং সার্ফিংয়ের জন্য সমুদ্র সৈকতের জনপ্রিয়তা রয়েছে।

বর্ষায় চলে যেতে পারেন পছন্দের জায়গায়। বন্ধু বান্ধব কিংবা পরিবারের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ঝেড়ে ফেলতে পারেন শহরের ক্লান্তি। প্রকৃতির কোলে বসে বৃষ্টির জলে গা ভিজিয়ে হতে পারেন সতেজ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ঘুরে বেড়ানো

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two + six =