বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি : চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

সালেক সুফী

পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের রয়েছে স্থলভাগের সমান আয়তনের বিশাল সমুদ্রসীমা। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে প্রতিবেশী মায়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসা হয়েছে তাও একযুগ হয়ে গেলো। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমান সমুদ্র সম্পদ আছে বলে নানা সমীক্ষায় জানা গেছে। বিশেষত জ্বালানি খনিজ সম্পদ, মৎস সম্পদ ,অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ পরিকল্পিত উপায়ে আহরণ করা হলে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের সম্পদশালী দেশে পরিণত হতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ সাগরসীমা নিয়ে বিরোধ নিস্পত্তি হওয়ার একযুগ পেরিয়ে গেলেও উল্লেখ করার মত কোন অর্জন নেই বাংলাদেশের।

১৫ বছর ধরে তিন টার্মে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নানা সময়ে সাগর সম্পদ আহরণ বিষয়ে খোদ সরকার প্রধান আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করলেও অজানা কারণে এযাবৎ নীল অর্থনীতি বিকশিত হয়নি কাঙ্খিত মাত্রায়। দেশে জ্বালানী সরবরাহে তীব্র সংকট সৃষ্টি হলেও সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। সাগরে বিপুল পরিমান মৎস সম্পদ থাকার প্রমান থাকলেও খুব সামান্য আহরিত হচ্ছে।  অথচ বাংলাদেশের সাগর সীমা সন্নিহিত এলাকায় গ্যাস, তেল অনুসন্ধান করে বিপুল সাফল্য পেয়েছে প্রতিবেশী মায়ানমার, ভারত।  বাংলাদেশের সাগরে অনুসন্ধান করতে এসে কাজ করে গ্যাস থাকার ইঙ্গিত পেয়েও পেট্রোবাংলার সঙ্গে কিছু বিষয়ে আলোচনায় নিস্পত্তি না হওয়ায়  ফিরে  গাছে মার্কিন কোম্পানী কনোকোফিলিপস। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পস্কো দায়ু এবং ফরাসি কোম্পানী টোটালের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। গুরুত্ব দেয়া হয়নি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানী উড সাইড পেট্রোলিয়ামের স্বতঃপ্রণোদিত প্রস্তাবে।  ভাবতে পারেন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে সাগরে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে ঠিকাদার নির্বাচনে চার বছর অপচয় করা হয়েছে। পুরোনো সরকার নতুন টার্মে এসে জ্বালানী বিদ্যুৎ নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সাগরের সম্পদ আহরণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিদ্যমান ভুরাজনীতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় সাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন দুই পরাশক্তির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। বিশেষত জ্বালানী সম্পদ সমৃদ্ধ মায়মানরের প্রতি আগ্রহ চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া সবার। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সাগরের জ্বালানী সম্পদ আহরণ কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সেটি দেখবার বিষয়। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী টেন্ডার ছাড়াই গভীর সাগরে ১৫ টি ব্লকে কাজ করার ইচ্ছা বারবার প্রকাশ করছে। দেশে কর্মরত মার্কিন কোম্পানী শেভরন সাগরে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার মার্চ ২০২৪ গভীর সাগরে নতুন করে পিএসসি বিডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানিনা ভূরাজনীতির বিদ্যমান অবস্থায় কতটা প্রভাবহীনভাবে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সাগর থেকে সুসংবাদ পেয়ে কাজে লাগাতে কিন্তু ২০৩০ পর্যন্ত সময় লাগবে। দেখতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া এবং নতুন করে মায়ানমারে সংকট শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের সাগর অনুসন্ধান কাজ কতটা নির্বিঘ্ন হবে।  বাংলাদেশের কারো গভীর সাগরে গ্যাস তেল অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা নেই। এই বিষয়ে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞতা আরো সীমিত। বাংলাদেশে সাগরে অনুসন্ধান কাজ তদারকির জন্য তাই বিদেশে কাজ করা অভিজ্ঞ এবং আগ্রহী বাংলাদেশীদের খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ করতে হবে। এমনকি পিএসসি বিডিংয়ে প্রাপ্ত প্রতাবগুলো সঠিক মূল্যায়নের জন্য, সফল প্রস্তাবকারীদের সঙ্গে নেগোশিয়েশনের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হবে।

জানি সরকার প্রধান আন্তরিক এবং দৃঢ়চেতা। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ভুল পরামর্শের কারণে অতীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সাগরে অনুসদ্ধান নিয়ে কিন্তু ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ কতটা স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার উপর নির্ভর করবে সাফল্য।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক এলাকায় একদিকে ভারত অন্যদিকে মায়ানমারের সঙ্গে যৌথ উন্নয়ন এগ্রিমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে।

তেল গ্যাস একমাত্র সাগর সম্পদ নয়। বিপুল মৎস সম্পদ আছে বাংলাদেশের সাগর এলাকায়।  পেশাধারী ভিত্তিতে গভীর সাগরের মৎস সম্পদ আহরণ করা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। অফশোরে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন, কাজে লাগিয়ে হাইড্রোজেন উৎপাদন করার সম্ভাবনা আছে। সরকার প্রধানকে নীল অর্থনীতি একটি পৃথক বিভাগ করে নিজ দায়িত্বে রাখা জরুরি মনে করি। সেখানে আমলাদের পরিবর্তে বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দিয়ে কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six − three =