বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের তিন উদীয়মান নক্ষত্রের কথা বলছি

সালেক সুফী

২০০৫ থেকে ২০২৩, দীর্ঘ ১৮ বছর দেশ ছেড়ে প্রবাসে থাকলেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আমার স্বপ্নের দেশ। প্রতিদিন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবি, নানা মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ সাফল্য, সম্ভাবনা, সমস্যা, সঙ্কটের বিষয়ে অবহিত থাকি। সেই ১৯৭২ সূচনা থেকেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে ছিল আমার নাড়ির যোগাযোগ। এখন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিদিনের অর্জন নিবিড়ভাবে মনিটরিং করি।

সম্প্রতি ক্রিকেট এবং ফুটবলে তিন অসামান্য প্রতিভাবান, উদীয়মান তারকার অর্জন আমাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, সঠিক পরিচর্যা করা হলে এবং পরিমিত পরিসরে ব্যবহার করা হলে ওদের হাত ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ও ক্রিকেট বহুদূর এগিয়ে যাবে। ক্রিকেটে আছে তাওহীদ হৃদয় এবং মারুফা আক্তার।  ফুটবলে শেখ মোরসালিন।

ক্রিকেটে বাংলাদেশ অর্জনে এবং বিশ্ব পরিচিতিতে অন্য সকল খেলাকে ছাড়িয়ে গেছে বলে অত্যুক্তি হবে না। সবাই স্বীকার করে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম, রিয়াদ নামের ৫ বিশ্বমানের খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি দিয়েছে। একসময়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ আশরাফুল বাংলাদেশকে বিশ্বক্রিকেটে চিনিয়েছিল। তাসকিন, মুস্তাফিজ ধূমকেতুর মত আবির্ভুত হলেও এখনো উন্নয়নের ধারাকে টেকসই করতে পারেনি। বেশ কিছু দিন থেকেই বিশ্বমানের  নতুন প্রতিভা বিকশিত হচ্ছিল না। এমনি সময় ছেলেদের ক্রিকেটে বিস্ময় জাগানো তাওহীদ হৃদয় এবং মেয়েদের ক্রিকেটে মারুফ আক্তার আবির্ভাবেই আলোড়ন তুলেছে।

বুলবুলের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলি। আইসিসির উন্নয়ন ব্যবস্থাপক হিসাবে কর্মরত বুলবুল নানা দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে কাজ করে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগেই তাওহীদ হৃদয় নিয়ে সম্ভাবনার কথা বলেছিল।  আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অনুর্ধ ১৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে তরুণ ক্রিকেটারদের বিষয়ে উৎসাহী ছিলাম। নানাভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওদের ফলো করতাম।

কোভিড অতিমারীর কারণে দুই বছর বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি। ২০২২ ক্রিকেট মৌসুমে বাংলাদেশে ক্রিকেট দেখার সুযোগ হওয়ায় তাওহীদ হৃদয়ের কয়েকটি ইনিংস দেখার সুযোগ হলো বিপিএলে। ১৯৬০ এর দশক থেকে ক্রিকেট দেখা চোখে ধরা পড়লো মৌলিক প্রতিভা, নিবেদন এবং প্রতিজ্ঞা। বলা বাহুল্য অচিরেই মূল দলে সুযোগ পেয়ে ইতিমধ্যেই পারফরমেন্স দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে টপ অর্ডার পজিশনে। রক্ষণ কাজে দক্ষ, ব্যাটিং রোটেশনে কুশলী, স্ট্রোকস খেলায় সহজাত হৃদয়ের খেলায় অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা কাল দেখছিলাম শ্রীলংকা প্রফেশনাল লীগে হৃদয়ের কুশলী ব্যাটিং। আমি জেনেছি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আশা তাওহীদ হৃদয়ের সংগ্রামের কথা। বিশ্বাস করি সহায়ক পরিচর্যায় হৃদয় বিকশিত হবে। ওর মাঝে ইতিমধ্যেই আমি মুশফিকের মত প্রতিজ্ঞা এবং আত্মবিশ্বাস দেখেছি।

এরপর আসি খুদে বালিকা মারুফা আক্তারের কথায়।  নীলফামারীর সাদাসিধা সহজ সরল মেয়েটি প্রথম আবির্ভাবেই বাংলাদেশের মেয়ে দলের হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছে মেয়েদের ক্রিকেটের পরাশক্তি ভারতকে। বাংলাদেশ যেভাবে টি২০ সিরিজে পিছিয়ে থেকেও তৃতীয় ম্যাচ জিতে ধবল ধোলাই এড়ায় এবং এর পর ওডিআই সিরিজ ১-১ শেষ করে তাতে রয়েছে মারুফার অসামান্য  অবদান। ভাবতেই অবাক লেগেছে নীলফামারীর কিষাণী মেয়ে চিতার মত ক্ষিপ্রতায় ছুটে এসে ধসিয়ে দিলো তুখোড় ভারত ব্যাটিং।

স্মৃতি মান্দানার মত তুখোড় ভারতীয় ব্যাটসম্যানের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করলো। শেষ ম্যাচটিতে প্রথম ওভারে ওর নিজের বলে অসাধারণ ক্যাচ এবং শেষ ওভারে চোখে মুখে হার না মানা বিচ্ছুরণ মনে থাকবে বহুদিন। দেখলাম মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এমনি অনেক ক্রীড়া প্রতিভা অনাদরে অবহেলায় বকুল ফুলের মত ঝরে পরে।  ওদের কুড়িয়ে এনে সঠিক পরিচর্যায় বিকশিত করা হলে আমাদের খেলাগুলো গতিময় হবে।

এবার আসুন ফুটবল এবং শেখ মুরসালিন প্রসঙ্গে।  ১৯৬০-২০০০ পর্যন্ত নানাভাবে বাংলাদেশ ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ফুটবলের অধোগতির কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে মেয়েদের ফুটবলের সাফল্য আমাকে আবারো উৎসাহিত করে। ছেলেদের ফুটবল মাঝে মাঝে ফলো করেছি। বিশেষত আমার প্রিয় দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ২০২৩ সাফল্য আমাকে আবারো বাংলাদেশ ফুটবল নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দেয়। আরো যখন জেনেছি আমার শহর ফরিদপুরের তরুণ শেখ মোরসালিন একজন উদীয়মান স্ট্রাইকার আগ্রহ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিলো।

আমি কিন্তু বাংলাদেশ সফরকালে সুদূর কুড়িগ্রামে ফুটবল পাগল লাইজুর ক্রিকেট আয়োজন দেখতে গেছি , সাতক্ষিরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফুটবলের জনপ্রিয়তা দেখেছি। কিন্তু ঢাকা ফুটবলে বিদেশি ফুটবলারদের দাপটে বাংলাদেশের ছেলেদের বিকশিত হবার বাধার মুখেও যেভাবে মোরসালিনের মত সহজাত প্রতিভা উঠে এসেছে তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হয়।  বিশেষত এবারে সাফ ফুটবলে সপ্রতিভ মোরসালিনকে দেখে সহজাত সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার মনে হয়েছে।  ঠিক যেন স্বর্ণযুগের এনায়েত, সালাহউদ্দিন। আমি আমার ফরিদপুরের তরুণ মোরসালিনের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি।

ইদানিং দেখছি ব্যারিস্টার সুমন  অন্যান্য কাজের পাশাপাশি দেশব্যাপী ফুটবল জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ওর কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাফুফে দেশব্যাপী ফুটবলের জনপ্রিয়তা পুঁজি করে সাংগঠনিকভাবে ফুটবলকে এগিয়ে নিতে পারে।

পরিশেষে বলি হৃদয়, মারুফা, মোরসালিন আমাদের নবপ্রজন্মের জাগ্রত প্রতিভা। ১৭ কোটি ক্রীড়া পূজারী মানুষের মাঝে এমনি অনেক সহজাত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। দেশব্যাপী ক্রীড়া উন্মাদনা জাগাতে পারলে বাংলাদেশ ৫-১০ বছরে সকল খেলায় বিশ্ব অঙ্গনে আলো ছড়াবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 1 =