বাংলার মায়াভরা পথে আর হাঁটবেন না প্রতুল

১৯৪২ সালের ২৫ জুন বরিশালে জন্ম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের। ৮৩ বছর বয়সে কলকাতায় জীবনপথের যাত্রা শেষ হলো তাঁর। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে মারা যান এই গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী। বাংলাকে খুব ভালোবাসতেন প্রতুল। তাই তো সৃষ্টি করেছিলেন ‘আমি বাংলায় গান গাই’। বার্ধক্যের কারণে এক মাসের বেশি সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এক সপ্তাহ ধরে ছিলেন আইসিইউতে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে। সেখান থেকে আর ফেরা হলো না তাঁর। মৃত্যুর আগে দেহ দান করে গিয়েছিলেন প্রতুল। তাই রবীন্দ্র সদনে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে সম্পন্ন হয় তাঁর দেহ ও চক্ষুদানের প্রক্রিয়া।

গান দিয়ে ম্যাজিক করে, দিব্যি চলে গেলেন, —কবীর সুমন, সংগীতব্যক্তিত্ব

আমি যদি এ জীবনে একজনও প্রকৃত নিরীক্ষামনস্ক নাগরিক মধ্যবিত্ত বাংলাভাষী সংগীতকার দেখে থাকি—তিনি প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ওঁর চেয়ে নিরীক্ষামনস্ক কেউ কোনো দিনই আসেননি। ওঁর ধারে-কাছে আমি তো নেই, কেউই নেই। কিন্তু আমরা ‘গান’ বলতে এখনো ওই হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-লতা—এই রকমটাই বুঝি।

বড় বড় কথা বলি গান নিয়ে, কিন্তু এটুকুর বাইরের বাংলা গান নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া তৈরি হয়নি। সংগীতশিক্ষা নেই, আলোচনা নেই, সংগীত-সাহিত্য নেই। ফলে কীভাবে সংগীত নিয়ে কথা বলা দরকার, চর্চার দরকার, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা নেই। ফলে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে আমরা কতদূর বুঝতে পারব, সে নিয়ে সন্দেহ আছে।

প্রাথমিকভাবে আমাদের শোনা দরকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান। অভিনিবেশ সহকারে শোনা। এবং ওই গান-পৃথিবীতে সবাই ঢুকতে পারবে না, কারণ প্রবেশযোগ্যতা লাগবে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় যদিও জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি রচনা করে, পরিবেশন করে, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় না, ওটা ওঁর ‘আসল’ গান-পরিচয়। গুরুত্বপূর্ণ এই গান বাঙালিদের ভালো লাগবে, অবাঙালিদেরও খারাপ লাগার কথা না।

কিন্তু ওঁর প্রধান কাজ—যা গান হতে পারে না, এ রকম কথায় সুর দেওয়া। ধরা যাক, ‘একটি ছেলে বল খেলিতেছে।’ একটা কবিতা পঙক্তি এটা। সম্ভবত মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশি এক কবিতার অনুবাদ। প্রতুল মুখোপাধ্যায় একই সুরে, একই টোনে এই ‘একটি ছেলে বল খেলিতেছে’কে নানা রকমভাবে পড়তে থাকলেন। সে এক আশ্চর্য মুগ্ধকর ব্যাপার! গায়কির এ এক যুগান্তকারী দিক উন্মোচন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও তথাকথিত শিক্ষাদীক্ষার ধার ধারতেন না, কিন্তু আসল শিক্ষাটা ওঁর চিন্তা থেকেই তৈরি হচ্ছে।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক-দুটি অনুষ্ঠানে আমি কি-বোর্ডস বাজিয়েছিলাম। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম সেই অনুরোধ। সে অনেক আগের কথা। আমার এক বন্ধু ওঁর গানের সঙ্গে হারমোনিয়ামও বাজাতেন এককালে। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, এই পথটা ওঁর নয়, উনি খালি গলাতেই গাইবেন।

অরুণ মিত্রর লেখা কবিতা ‘নিসর্গের বুকে’র কথা মনে করুন। ‘আমি এত বয়সে গাছকে বলছি/ তোমরা ভাঙা ডালে সূর্য বসাও।’ এটা কিন্তু তিনি গান করে তুললেন। এ এক বিরাট ইতিহাস! গান যে একটা পারফরম্যান্স, সেটা নাগরিকদের মধ্যে উনিই প্রথম সিরিয়াসলি দেখালেন।

বুকের পাটা না থাকলে এভাবে গান গাওয়া যায় না। যন্ত্র নেই, কিচ্ছু নেই, খর্বকায় রোগাপটকা লোক— গান গাইলেন। একটা জীবন চলে গেল। গান দিয়ে ম্যাজিক করে, দিব্যি চলে গেলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর শুনে খারাপ লাগছে। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তবে তাঁর অনেক গান শুনেছি। বিশেষ করে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি। এটি শুধু আমার নয়, সব বাঙালিরই প্রিয় একটি গান। এই গানের মধ্যে পুরো বাংলাকেই কী অসাধারণ শিল্পের ছোঁয়ায় তুলে ধরেছেন তিনি!

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মতো এমন একজন গুণী মানুষের জন্ম হয়েছিল এই দেশে, এটাও আমাদের জন্য গর্বের। ওনার মতো সংগীতব্যক্তিত্বকে হারানো সংগীতাঙ্গনের জন্য বিরাট ক্ষতি। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো না। তিনি চলে গেলেও তাঁর সৃষ্টি দিয়ে বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে। গানের পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও ছিলেন বলিষ্ঠ। দেশ, বাংলা আর মানুষের জন্য সব সময়ই তাঁর ভাবনা ছিল ইতিবাচক। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − one =