বাংলা কবিতায় ছন্দ

রফিক হাসান

আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা প্রায় বদ্ধমূল যে আধুনিক কবিতা ছন্দহীন বা আধুনিক কবিতা লিখতে ছন্দ জানার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি যারা দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন এবং যাদের কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয় তাদের মধ্যেও অনেককে অনেক সময় বেশ জোর গলায় এমন সব কথাবার্তা বা মন্তব্য করতে শোনা যায়। আসলে ব্যাপারটি কী বা কেন তারা এমন কথা বলেন? বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

এমন ধারণা পোষণ করার প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে তারা মনে করেন অন্তমিলই হচ্ছে কবিতার ছন্দের মূল উপাদান। কাজেই যে কবিতায় অন্তমিল নেই সেটিই ছন্দহীন কবিতা। এই ধারণা থেকেই মূলত এসব মন্তব্য প্রকাশ পায়।

তাদের ধারণা একটি কবিতার এক লাইনের শেষ শব্দের সাথে পরবর্তী লাইনের শেষে অবশ্যই মিল থাকতে হবে। একেই বলা হয় অন্ত মিল। তাদের ধারণা এই অন্তমিল না থাকলে সেটি ছন্দবদ্ধ কবিতা হবে না।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে অন্তমিলই কবিতায় ছন্দের একমাত্র উপাদান নয়। অন্তমিল অবশ্যই ছন্দের একটি উপাদান তবে একমাত্র বা অনিবার্য নয়। অন্তমিল ছাড়াও কবিতা সম্পূর্ণ ছন্দবদ্ধ হতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে থাকে। সাধারণ পাঠক সেটি ধরতে পারেন না বলেই সস্তা মন্তব্য করেন বা কবিকে ছন্দহীনতার জন্য দায়ী করেন।

এর সব চেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেন আধুনিক বাংলা কবিতার জনক হিসেবে খ্যাত মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনিই মূলত অন্তমিলহীন অথচ পুরোপুরি ছন্দবদ্ধ কবিতার প্রবর্তক। তিনিই সর্বপ্রথম অন্তমিলের বাধ্যবাধকতা থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তি দেন।

মধুসূদন লিখিত বিখ্যাত ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে তিনি অন্তমিল ব্যবহার করেননি কিন্তু ছন্দের সব নিয়মকানুন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনুসরণ করেছেন। তিনিই বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। যেসব পাঠকের ছন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই তারাই কেবল বলে থাকেন যে মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্যে ছন্দ নেই। অথচ মাইকেলের মেঘনাদ বধ কাব্যের ছন্দ নিয়ে ছান্দসিকরা ভুরি ভুরি রচনা লিখেছেন।

গত দুইশ বছর ধরে বাংলা কবিতা মাইকেলের পথ অনুসরণ করেই অগ্রসর হয়েছে। বাংলাছন্দে অনেক নতুন নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছে তবে কখনই একেবারে ছন্দহীন হয়ে পড়েনি। বরং বলা যেতে পারে বাংলা কবিতার ইতিহাস মূলত ছন্দেরই ইতিহাস।

এখন কবিতায় ছন্দ বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা নেওয়া যেতে পারে। ছন্দের তাত্ত্বিক বা উৎপত্তিগত জটিল আলোচনায় না গিয়ে আমরা বাংলা কবিতার ছন্দের মৌলিক বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করতে পারি।

ছন্দ বলতে আসলে এক কথায় বলা যেতে পারে ছন্দ হচ্ছে দোলা। আমাদের অন্তরে সোজাসুজি কোনো ভাব বা বিষয় সহজে প্রবেশ করে না। সেজন্য কিছুটা দোলার প্রয়োজন হয়। এজন্য গানে সুর ব্যবহার করা হয়। সুর ছাড়া গান হয় না। সুর ছাড়া গান মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে না। গানের যেমন সুর কবিতার তেমন ছন্দ।

সব শিল্পেরই মূল লক্ষ্য মানুষের অন্তর। মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই না হলে সে শিল্প বেশিদিন টিকে থাকে না। কবিতারও মূল লক্ষ্য মানুষের হৃদয়। মানুষের অন্তরে প্রবেশ করার জন্য তাকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আর এই কৌশলের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ছন্দ। এজন্য কবিতায় ছন্দের এত মূল্য বা গুরুত্ব।

বাংলা কবিতার ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। সেই আদিম যুগে যে চর্যাপদ লেখা হয়েছিল তার মধ্যেও ছন্দ ছিল অত্যন্ত প্রবল। আজকের আধুনিক বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত অধিকাংশ ছন্দেরই আদিম নিদর্শন চর্যাপদের দোঁহাগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। যদিও তখনকার ছন্দ আজকের মতো কঠিন নিয়মে আবদ্ধ ছিল না। ছিল অনেকটা শিথিল। তারপরও এটা বলা যাবে না যে তাতে কোনো ছন্দ নেই বা চর্যাপদের কবিরা ছন্দ জানতেন না।

বরং বলা যেতে পারে ছন্দের হাত ধরেই গত এক হাজার বছর ধরে বাংলা কবিতা নামের নদীটি প্রবাহিত হয়ে আসছে এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতেও প্রবাহিত হবে। ছন্দের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে যা কি না অতীতেও হয়েছে। তারপরও বলা যেতে পারে যে বাংলা কবিতা পুরোপুরি ছন্দহীন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

কারণ ছন্দ কবিতার কোনো আলগা পোষাক নয় যে কবিতার শরীর থেকে তাকে খুলে ফেলা যাবে। বরং বলা হয়ে থাকে ছন্দ হচ্ছে কবিতার স্বভাব। কবিতার প্রাণ। একটি কবিতা থেকে তার ছন্দকে বাদ দেওয়া হলে সেটি আর কবিতা থাকে না। সেটি কবিতার লাশ হয়ে যায়।

এজন্য বলা হয়ে থাকে যে এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় কবিতা অনুবাদ করতে গেলে যে জিনিসটা আনা যায় না, সেটিই আসল কবিতা। আর সেটি হচ্ছে মূলত ছন্দ। কারণ ছন্দের অনুবাদ হয় না। অনুবাদ হয় ভাব বা কথার।

শোনা যায় প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যকে সহজ করে লেখার কথা ভাবতেন। যেহেতু মাইকেলের কবিতা অত্যন্ত কঠিন দাঁতভাঙা শব্দ আর মিলহীন অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা কাজেই তার ধারনা হয়েছিল যে এটিকে সহজ করে অন্তমিলযুক্ত ছন্দে লিখলে বোধহয় পাঠকের বোধগম্য হবে।

কিন্তু পরবর্তীকালে তার সে ধারণা পাল্টে যায় এবং তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে কবিতা থেকে তার ছন্দকে আলাদা করা হলে সেটি তার মূল চরিত্র হারিয়ে প্রাণহীন হয়ে যায়। সেটি আর কবিতা থাকে না। মেঘনাদ বদ কাব্যের যে বীর রস এবং গাম্ভীর্য তা কেবল অমিত্রাক্ষর ছন্দেই যথাযথ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। অন্য কোনো ছন্দে তাকে উপস্থাপন করতে গেলে পুরো বিষয়টিই মাঠে মারা যাবে।

এবার বাংলা কবিতার প্রধান ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া যেতে পারে।

বাংলা কবিতার প্রধান ছন্দ মূলত চারটি। কেউ কেউ অবশ্য তিনটি বলে থাকেন। তবে আমরা চারটি বলব। তাহলে আধুনিক কালে যে সব কবিতা লেখা হচ্ছে তার সবগুলোকে অর্ন্তভুক্ত করা যাবে এবং একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করা সম্ভব হবে। যে কাজটি করেছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, গবেষক ও ছান্দসিক আব্দুল মান্নান সৈয়দ।

তার মতে বাংলা কবিতার প্রধান ছন্দ মূলত চারটি। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও নিরেট গদ্য। প্রথম তিনটি ছন্দকে সব ছান্দোসিকই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে শেষেরটির ব্যাপারে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা নিরেট গদ্যকে আলাদা একটি ছন্দ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তবে আলোচনাকে সহজ করার জন্য আমরা শেষেরটিকেও একটি ছন্দ হিসেবে স্বীকার করে নিতে পারি।

প্রতিটা ছন্দের আবার রয়েছে নানা রকম চাল। এই চালের কারণে কবিতার ধরন ও অবয়বও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এক ছন্দের কবিতা থেকে আর এক ছন্দের কবিতার পার্থক্যও ঘটে মূলত এই চালের কারণে। অনেক বড় ও দক্ষ কবি এই চালকে ব্যবহার করে এমন কবিতা রচনা করেছেন যার ফলে তার কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আধুনিক কালের সবচেয়ে দক্ষ ও বিশুদ্ধ কবি হিসেবে খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মধ্যে মাত্রাবৃত্তের চাল ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে প্রথমদিকে অনেক শিল্পরসিক ব্যক্তিগণ জীবনানন্দের কবিতার ছন্দ ধরতে পারেননি। এমনকি সে যুগের অনেক বিখ্যাত কবিও মনে করতেন যে জীবনানন্দ দাশ ছন্দ জানেন না। ফলে তার কবিতায় এত বিশৃঙ্খলা।

কিন্তু পরবর্তীতে অনেক চুল চেরা বিশ্লেষণের পর জানা গেল যে জীবনানন্দ প্রায় সব কবিতাই কোনো না কোন ছন্দের চাল ব্যবহার করে রচনা করেছেন। তিনি অত্যন্ত ছন্দ সচেতন একজন কবি। কিন্তু ছান্দসিকরা প্রথম প্রথম সে সব চাল ধরতে পারেননি।

কাজেই ছন্দের বিষয়টা এতই জটিল এবং বিশ্লেষণ সাপেক্ষ একটি বিষয়। পরবর্তী আলোচনায় আমরা বাংলা কবিতার প্রতিটি ছন্দের নানান চরিত্র ও চাল নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। যাতে করে পাঠকবৃন্দ বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে একটি প্রথমিক ধারণা লাভ করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে ছন্দ একটি শাস্ত্র। ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র বা বিজ্ঞানশাস্ত্রের মতই এর ব্যাপক বিস্তার। কাজেই একটি দুটি নিবন্ধ বা প্রবন্ধের মাধ্যমে এর সব দিক আলোচন সম্ভব নয়। আমরা এখানে বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে শুধুমাত্র প্রাথমিক একটি ধারনা লাভ করার চেষ্টা করতে পারি। যারা ছন্দ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করতে চান বা ছান্দসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে চান তাদের জন্য ভুরি ভুরি পুস্তকসহ অন্য অনেক পথ খোলা রয়েছে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ ২

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 4 =