বাতাস, পানি এবং মাটি দূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। এদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশদূষণ জনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। আর এই দূষণ হতে পারে ত্রিমাত্রিক বাতাসে, পানিতে এবং মাটিতে।

ক্রমাগত বাড়ছে বায়ু দূষণ। কল-কারখানার ধোঁয়া, গাড়ির দূষণ, খনি, ফসল খেতের আগুন সবই বাতাসের পরিস্থিতি মারাত্মক করে তুলছে। এর ফলে বাতাসে পিএম ২.৫ নামে এক ধরনের কণা ছড়িয়ে পড়ে, মাত্র ২.৫ মাইক্রোমিটার তার ব্যস, কখনও তারচেয়েও কম। এই কণা সহজেই মানুষের নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পরে রক্ত। যা থেকে জন্ম হতে পারে নানা ধরনের জটিল অসুখ।

বাতাসে ধূলিকণার পাশাপাশি যোগ হচ্ছে জ্বালানি তেলের বর্জ্য, সীসা, তামাকের ধোঁয়াসহ অন্যান্য দূষিত উপকরণ। সাধারণত, যানবাহনের ইঞ্জিন ও জেনারেটরের জ্বালানি পোড়া ধোঁয়া, কলকারখানা ও কৃষিজাত ধোঁয়া, রান্নায় ব্যবহৃত জ্বালানি পোড়া ধোঁয়া, রাসায়নিক কারখানার ধোঁয়া ও যেকোনো অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া থেকে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ বাতাসে আসে।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার বায়ু দূষণকে প্রথম সারির কারসিনোজেন হিসেবে দেখিয়েছে, যা ক্যানসার তৈরি করে। ল্যানসেট কমিশন দাবি করেছে, সারা বিশ্বে ৪৩ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসার-জনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী দূষণ। এই অতিসূক্ষ্ম কণার সঙ্গে এপিডারমাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপটর জিন মিউটেশনের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। অ-ধূমপায়ী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে এটা দেখা যায়। সব থেকে সমস্যার বিষয় হল, বিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষই দূষণে বাস করেন।

এতো গেলো বাতাসের কথা। দিন দিন শিল্পে রাসায়নিকের বাড়তি ব্যবহার, শিল্পকারখানা, খনি, কৃষিকাজের দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটিকে বিষিয়ে তুলছে। দূষণের কারণে খাদ্য ও পানি অনিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি মাটি ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি এখনি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়ে তা ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিশোধিত পোলট্রি বর্জ্য সরাসরি জমিতে ও জলাধারে ব্যবহার করায় শাকসবজিতে ঢুকে পড়ছে রোগজীবাণু। অন্য দিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশের মাটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরন এবং অঞ্চলভেদে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি রয়েছে।

শুধু চাষেই নয়, অন্যভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের দূষণ। প্রতিদিন দেশে কমছে কৃষিজমি এবং প্রাকৃতিক পানির উৎসস্থল। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটি দূষণের সাথে দূষিত হচ্ছে পুরো পরিবেশ। জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে যাচ্ছে। দূষণ ছড়াচ্ছে পানিতেও। ফলে মাটি-পানি থেকে উৎপাদিত খাদ্য মানুষের শরীরে গিয়ে তাদের অজান্তেই মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে।

সে সাথে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দেহে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ব্যাধির প্রধান কারণ বিষাক্ত খাদ্য। পরিস্থিতি এখনি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়ে তা ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন বলেন, অব্যাহত দূষণে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। এই মাটি-পানি থেকে যা উৎপাদন হয় তা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। ফলে মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার ঝুঁকিতে পড়ছে। তিনি বলেন, এটা এখনি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একসময় তাতে একসাথে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।

পরিবেশবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীর মধ্যে ১০ থেকে ২০ নম্বরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান। এতে করে পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ, পয়ঃনিষ্কাশন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকা একটা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে পড়েছে। এতে করে ঢাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, পরিবেশ দূষণের বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যেমন বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ ইত্যাদি রয়েছে। এর সবগুলোর ফলেই কোন না কোনোভাবে মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

তিনি বলেন, এর কিছু ক্ষতি প্রত্যক্ষভাবে হচ্ছে। যেমন কীটনাশক মেশানো লিচু খেয়ে শিশু মারা গেল বা বিষাক্ত মাছ খেয়ে কেউ অসুস্থ হলেন। আবার কিছু ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। যেমন রাসায়নিক বা কীটনাশক মেশানো বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেলো। বা দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে থেকে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হলেন। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে।

রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে।  পানি দূষণে সাময়িক প্রভাবের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক বেশি। বিশেষ করে শিল্প কারখানার বর্জ্য মানব দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এসব পানি ব্যবহার চর্মরোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের মতো রোগ হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, দূষিত পানি বা নদীর ভেতর যেমন মাছ বা প্রাণী থাকে, যেসব ভেষজ উৎপন্ন হয়, দূষণ সেসব প্রাণীর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানব দেহের শরীরে চলে আসে। ফলে সরাসরি দূষিত পানির কাছাকাছি না থাকলেও, সেসব দূষিত পদার্থ এসব মাছের মাধ্যমে মানব দেহে আসে, যার ফলে ত্রুটি পূর্ণ জন্ম বা ক্যান্সার হতে পারে।

এমনকি খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকছে সীসা, প্লাস্টিকসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ। শুধু খাদ্যচক্র নয়, পথের শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদ্‌রোগ, মাথাব্যথা, স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটির তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যার তৈরি হতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত সার ও কীটনাশকের কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি। সেই দূষণ যাচ্ছে উৎপাদিত ফসলে। বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যা হচ্ছে। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারেরও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরনের দূষিত খাবার খেলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 + 5 =