বায়ু দূষণ কমাতে আশা জাগানিয়া ঘোষণা

মুশফিকুর রহমান

 দিন আগে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছিল। সে ছিল স্বস্তির বৃষ্টি। বাতাসে ভেসে থাকা ধুলা আর ধোঁয়া সামান্য কিছুটা হলেও তাতে সরে গেছে। হোক না সে স্বস্তি সামান্য সময়ের জন্য। শীত যাই যাই করেও ফেব্রুয়ারি মাসের অন্তত মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকছে বলেই মনে হয়। গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। বসন্তের ফুলও কোনো কোনো গাছে এসে গেছে। শীতের পিঠা পুলি খাবার আয়োজনও থেমে নেই। তবে শীত এলে দেশে যে সমস্যা তীব্র হয়ে উঠে তার মধ্যে বাতাসের দূষণ রীতিমতো দুর্যোগে পরিণত হয়। এসময়, মানুষের শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ তীব্রতর হয়ে উঠে। অন্যান্য কারণের সাথে বাতাসে দূষণের ইন্ধন এসময় রোগ বালাই তীব্র হতে সহায়তা করে।

সংবাদমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত দেশের বায়ু দূষণ শীর্ষে কোন শহরের অবস্থান তার সূচক প্রকাশ করে থাকে। বায়ু দূষণ সূচকে মহানগরী ঢাকা বিশ্বের শীর্র্ষস্থানীয় কয়েকটি শহরের একটি হিসেবে ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে। বছর গড়িয়ে নতুন বছর আসে, দেশের শহরগুলোর বায়ু দূষণের সূচকে ক্রমশ অবনতি অব্যাহত থাকার খবর আরও বড় শিরোনামে প্রকাশিত হতেই থাকে।

এমন নয় যে বায়ু দূষণ এবং তার কারণ অজানা। বাংলাদেশের সরকারি সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের জরিপ, নিয়মিত মনিটরিং করে বায়ু দূষণের কারণগুলো এবং দূষণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কোন খাতের কি ভূমিকা তা চিহ্নিত করেছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা নিয়ে পরিচালিত জরিপ, গবেষণার ফলাফল এবং বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করবার উপযোগী পরামর্শ সরকারের জানা।

দেশে শহরাঞ্চলে ঘরের বাইরের বায়ু দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম: ইটভাটার দূষণ, যানবাহনের দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, আবর্র্জনা পোড়ানোর দূষণ, নির্র্মাণ কাজের কারণে সৃষ্ট দূষণ ইত্যাদি। এসময়, দেশের বাতাসে ট্রান্সবাউন্ডারি বা দেশের সীমানার বাইরে থেকে বায়ুতাড়িত দূষণের মাত্রাও বেড়ে যায়। বলা বাহুল্য, বায়ুর দূষণ উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস এবং ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতির কথা বোঝানো হয়। শুকনো মৌসুমে দেশে বায়ু দূষণের মাত্রা তীব্র রূপ নেয়, কারণ সাধারণভাবে শুকনো মৌসুমে দীর্র্ঘ সময় বৃষ্টিহীন পরিবেশে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা এবং ক্ষতিকর গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় ।

ইট ভাটা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। দেশে নির্র্মাণ উপকরণের গুরুত্বপূর্র্ণ উপাদান কাদা পুড়িয়ে তৈরি করা ইট। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে অন্তত ৮ হাজার ইট ভাটা রয়েছে এবং বছরে প্রায় ৫% শতাংশ হারে ইট ভাটার সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর দেশের ইট ভাটাগুলো ইট তৈরির জন্য প্রায় ১৩ কোটি টন উর্র্বর মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করছে। সরকার নিয়মিত কৃষি জমি ধ্বংস করে শিল্পকারখানা নির্র্মাণ, নগর সম্প্রসারণসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্র্র্মাণের বিরুদ্ধে সতর্র্ক করলেও, ইট তৈরিতে বিশাল পরিমাণ ফসলি জমি কার্যত উর্বরতা হারাচ্ছে, চাষাবাস যোগ্যতা হারাচ্ছে।

দেশের বায়ু, মাটি, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও নির্র্র্র্মাণ উপাদান হিসেবে ইট উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় এক হাজার অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি ইটভাটা এক মৌসুমে কমপক্ষে ৬০ লক্ষ থেকে এক কোটি ইট উৎপাদন করে। চলমান ইট ভাটাগুলোর মধ্যে অন্তত ৪ হাজার ৫০০ ইটভাটার আবশ্যিক অনুমোদন হিসেবে পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।

প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর গত চার বছরে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১,০০০ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলোর অধিকাংশ নিয়ম ভেঙে আবার চালু হয়েছে। চলমান অধিকাংশ ইটভাটা জ্বালানি ব্যবহারে এবং প্রযুক্তিগত বিবেচনায় অদক্ষ ও সেকেলে। ব্যবহৃত জ্বালানির ক্ষেত্রেও ইটভাটাগুলোর অপচয় ব্যাপক, ফলে সেগুলো ব্যাপক দূষণের কারণ হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সামর্র্থের সীমাবদ্ধতার কারণে ইটভাটাসহ অন্যান্য দূষণকারীদের মনিটরিং অনিয়মিত এবং অনিয়ম করলেও শাস্তি দেবার সামর্র্থ সীমিত।

বাংলাদেশ সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবার পর তার ১০০ দিনের কর্র্মসূচি ঘোষণা করেছেন। অন্যান্যের মধ্যে বায়ু দূষণের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণে তিনি ১০০ দিনে ৫০০ অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিবেশ আইন অমান্যকারীদের চিহ্নিত করতে মন্ত্রী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একই সাথে ২০২৮ সালের পরে দেশে সরকারি কাজে আর মাটি পুড়িয়ে তৈরি ইট ব্যবহার না করার ঘোষণা দিয়েছেন। ইটের বিকল্প নির্র্মাণ উপকরণ হিসেবে সরকারি কাজে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার বাড়ানোর জন্য ইতিপূর্র্বে সময়সীমা বেধে দিলেও অগ্রগতি এখনও নগণ্য। এবার কাদা পুড়িয়ে তৈরি ইট সরকারি কাজে আর ব্যবহার না করার নতুন সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলো ২০২৮ সাল।

প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশে ইতিমধ্যে স্থাপিত কংক্রিট ব্লক ইট তৈরির স্থাপনা বা কারখানাগুলোর উৎপাদন সামর্থ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ব্লক। সরকারি নীতি সহায়তা পেলে স্থাপিত ক্ষমতার কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন সামর্থ পূর্ণউদ্যমে কাজে লাগাতে পারবে। নতুন উদ্যোক্তাও এগিয়ে আসবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারি কাজে কার্র্যকরভাবে কাদামাটি পুড়িয়ে তৈরি ইটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তার উপরে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হবে তা প্রধানত নির্ভর করবে। সেই সাথে অবৈধ ইটভাটা মালিকদের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনিক ক্ষমতাধরদের যে লাভজনক বোঝাপড়ার বলয় গড়ে উঠেছে সেটিকে কতটুকু পরিবর্র্র্তন করা সম্ভব হচ্ছে, তার উপর নির্র্ভর করবে অবৈধ ইটভাটা সমূহের অব্যাহত সংখ্যাবৃদ্ধি রোধ এবং ইট বা তার বিকল্প উৎপাদনের প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব রূপান্তর। এছাড়া, দেশের বায়ু দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখতে দূষণের অন্যান্য উৎসগুলোর প্রতিও মনযোগ বাড়ানো জরুরি।

মুশফিকুর রহমান: জ্বালানি ও পরিবেশ লেখক

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three − two =