বিটিভির ৬০

বিটিভি একটা আবেগের নাম। বিটিভি পূর্ণ রূপ বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিশেষ করে আশি অথবা নব্বই দশকে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের কাছে অন্য রকম এক আবেগের নাম বিটিভি। সেই সময় কোনো গ্রামে যাদের ছেলেবেলা কেটেছে তাদের মনে বিটিভি গেঁথে আছে রূপকথা হয়ে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ব্যাটারি দিয়ে সাদা-কালো টিভিতে বিটিভি দেখা সবার কাছে একটা অন্য রকম অনুভূতি ছিল। সপ্তাহজুড়ে বিটিভিতে বিভিন্ন আয়োজন থাকত। ওই সময় বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট খেলা দেখারও একমাত্র মাধ্যম ছিল বিটিভি। ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পার হয়ে গেল বিটিভির ৬০তম জন্মদিন। ৫৯ পেরিয়ে ৬০ বছরে পদার্পণ করেছে চ্যানেলটি। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে রইলো বিটিভির জন্য অনেক শুভেচ্ছা।

এন্টেনার যুগে বিটিভির মজা

টিভি ঝির ঝির করছে? ঠিক মতো ছবি আসছে না? বাড়ির সবচেয়ে ক্ষুদে কিশোর কিশোরীর দিকেই সবার নজর। অ্যান্টেনা ঘোরানোর দায়িত্বটা বুঝি তাদেরই! এভাবে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে যারা বিটিভি দেখেছেন তারা জানেন বিটিভির মজা। তখন বিটিভিই ছিল ভিজুয়্যাল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। এতো টিভি চ্যানেল ছিল না। ফেসবুক, ইউটিউব, এতো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিছুই ছিল না। ঘরে ঘরে টেলিভিশনও ছিল না। শুক্রবার মানেই টিভির ঘরটি হয়ে উঠতো মিনি সিনেমা হল। প্রতিবেশিদের ভিড় জমতো। সিনেমা দেখার প্রস্তুতি নেওয়া হতো বেশ সময় নিয়েই।

নব্বই দশকের সেই দিনগুলি

বিটিভিতে ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা রাত জেগে যারা দেখেছেন, তাদের কাছে বিটিভির আবেগ অন্যরকম। শুক্রবার বেলা তিনটায় বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। রাজ্জাক, আলমগীর, ববিতা, শাবানা, হুমায়ুন ফরীদি, সালমান শাহ আরও অনেক গুণী অভিনেতার স্মৃতিবিজড়িত সিনেমাগুলো পরিবার-পরিজনকে নিয়ে একসঙ্গে বসে দেখার সময়গুলো যেন গল্পের মতো। নব্বই দশকে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল আলিফ লায়লা অথবা সিন্দাবাদ। আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা গানের সেই সুর এখনো আলাদা একটা অনুভূতি সৃষ্টি করে। এ সুরের জাদু জীবনের মাঝবয়সে এসে এখনো সেই পুরোনো আবেগের জন্ম দেয়।

বিটিভির কালজয়ী নাটক-অনুষ্ঠান

সেই সময়ে বিটিভির কিছু নাটক ইতিহাস হয়ে আছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে না হয় এ জন্য সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিল। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এ ছাড়া ‘রূপনগর’, ‘আজ রবিবার’, ‘রবিনহুড’, ‘ম্যাকগাইভার’, কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘কৃষি দিবানিশি’, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক নাটক, সিনেমা আরও অনেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচার করেছে বিটিভি।

বিটিভির ইতিহাস

বিটিভির প্রধান সম্প্রচার কেন্দ্র ঢাকার রামপুরায়। ২০০৪ সালে বিটিভি বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারের জন্য বিটিভি ওয়ার্ল্ড নামে উপগ্রহভিত্তিক চ্যানেল স্থাপন করে। আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের লাহোরে প্রথম টেলিভিশন সেন্টারের উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় টেলিভিশন সেন্টারটি করা হয় বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান)। ঢাকায় ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক) ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনের ঢাকা কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত অনুষ্ঠানে প্রথম গান গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। গানটি ছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা ‘এই যে আকাশ নীল হলো আজ/ এ শুধু তোমার প্রেমে।’

টেলিভিশন কেন্দ্রের প্রথম প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার, জামান আলী খান ও মনিরুল ইসলাম। পরবর্তীতে আসেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আবদুল হাদী, দীন মোহাম্মদ, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আতিকুল হক চৌধুরী। অনুষ্ঠান বিভাগের প্রথম ব্যবস্থাপক ছিলেন কলিম শরাফী। সেসময় টেলিভিশনে প্রযুক্তির অভাবে সব অনুষ্ঠান লাইভ অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। চ্যানেল ছিল একটি, চলতো সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। সম্প্রচার সীমা ছিল ঢাকা শহরের চারপাশে দশ মাইল, তবে এর বাইরে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ফরিদপুর থেকেও তা দেখা যেত। ঢাকা টেলিভিশনের স্থাপনা তৈরি, পুরোপুরি চালু করা ও কিছুদিন দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল জাপানি টেলিভিশন কোম্পানি এনএইচকে। ঢাকা টেলিভিশন প্রথমে সাদাকালো হিসেবে শুরু হলেও ১৯৮০ সাল থেকে রঙিন সম্প্রচার করা শুরু করে। স্বাধীনতার পর সংস্থাটির নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এবং এটি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে রামপুরায় টেলিভিশনের নিজস্ব ভবন তৈরি করা হয়। এখন সেটি রামপুরা টেলিভিশন সেন্টার নামে পরিচিত।

অনলাইনে বিটিভি

এখন অনলাইনেও দেখা যায় বিটিভির চারটি চ্যানেল – বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, বিটিভি চট্টগ্রাম, সংসদ টেলিভিশন। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারে, ট্যাবেও উপভোগ করা যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন চ্যানেল।

৬০তম জন্মদিনে বিটিভির আয়োজন

২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিটিভি প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিলনমেলা। গান করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা। সকাল ৮টার সংবাদের পর প্রচারিত হয় ‘আজকের সকাল’। সংগীত পরিবেশন করেন অনিমা রায় ও আয়েশা জেবিন দীপা। দুপুর ১২টার সংবাদের পর চিত্রাঙ্কন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে ছিলেন কেরামত মাওলা, রফিকুন্নবী, আব্দুল মান্নান। বিকেল ৩টায় প্রচার হয় ‘বিটিভি নাটকের একাল সেকাল’। উপস্থাপনায় ছিলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতিথি ছিলেন ম হামিদ, ডলি জহুর, আব্দুল মান্নান, রওনক হাসান, স্বাগতা ও বৃন্দাবন দাস। এ ছাড়া দিনব্যাপী প্রচারিত হয় সংকলিত অনুষ্ঠান।

বিটিভির ৬০তম জন্মদিনে চ্যানেল আইয়ের আয়োজন

চ্যানেল আই প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বিটিভির জন্মদিনে নিজস্ব আঙিনায় আয়োজন করে বিশেষ অনুষ্ঠানের। এবারও ওইদিন সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠানটি, চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। বিটিভির শুরু থেকে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা। এছাড়াও ছিলো সংগীত পরিবেশনা, অতিথি আপ্যায়নে পিঠা-পুলির ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেন।

বিটিভি জাদুঘর

বিটিভির ‘টেলিভিশন জাদুঘর’-এর ছোট্ট কক্ষটিতে সাদাকালো আর রঙিন ছবিতে উঠে এসেছে বিটিভির ইতিহাস। সাদাকালো একটি ছবিতে দেখা যায় অভিনেতা গোলাম মুস্তাফাকে। যাত্রার সাজপোশাকে যাত্রামঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, পাশে ক্রন্দনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ফেরদৌসী মজুমদার। অন্য এক ছবিতে দেখা যায় ফেরদৌসীর সামনে বিশেষ ভঙ্গিতে বসে আছেন তরুণ বয়সের রামেন্দু মজুমদার। কোনো নাটকের দৃশ্য হবে এটি। ‘টেলিভিশন জাদুঘর’-এর উদ্বোধন হয় ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর। এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরে যেয়ে দেখে আসতে পারেন বহুব্রীহি নাটকের আফজাল হোসেন ও আসাদুজ্জামান নূরকে কিংবা মুস্তাফা মনোয়ার প্রযোজিত সেই বিখ্যাত নাটক ‘রক্তকরবী’র পাত্রপাত্রীদের। জাদুঘরে ফ্রেমবন্দি হয়ে আছেন সাদাকালো যুগের আনোয়ার হোসেন, লায়লা হাসান ও সৈয়দ হাসান ইমাম। কলকাতার বিখ্যাত গণসংগীতশিল্পী সলিল চৌধুরী ও তার পরিবারকেও পাওয়া যায় সেখানে। ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের প্রবাদ প্রতিম উপস্থাপক ফজলে লোহানীও আছেন। এখানে আরও আছেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম। বিটিভিতে এসে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

জাদুঘরের এক স্থানে দেখা যাবে ফ্রেমবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রামপুরা টিভি ভবন দেখতে এসেছিলেন তিনি, ছবিটি সেই সময়কার। এভাবে কত মুখ, কত চরিত্র বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যারা করেছেন, যেসব বিশিষ্টজন এসেছেন এখানে সবাই ছবি হয়ে আছেন। আছে নানা সময়ে বিটিভির সম্প্রচার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র ও ট্রান্সমিটার, ক্যানন স্কুপি১৬ এমএস মডেলের ১৬ এমএম নিউজ ফিল্ম ক্যামেরা, রোলেক্স এইচ১৬ রিফ্লেক্স মডেলের ১৬ এমএম ফিল্ম ক্যামেরা, সিপি১৬ মডেলের সিনেমা প্রোডাক্টস সাউন্ড ক্যামেরা। সত্তর দশকের সাদাকালো যুগে ব্যবহৃত এসব যন্ত্রাংশের পাশাপাশি দেখা মেলে আশির দশকের রঙিন যুগের যন্ত্রপাতির। যেমন কেসি৫০ মডেলের রঙিন ক্যামেরা, ভিডিও টেপ রেকর্ডার, অডিও ডিস্ক প্লেয়ার, পোর্টেবল মনিটর প্রভৃতি। একটি কাচের বাক্সে রাখা আছে হাতে লেখা সংবাদের পাণ্ডুলিপি, নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ, সেলিম আল দীন ও হুমায়ূন আহমেদের হাতে লেখা নাটকের পাণ্ডুলিপি।

শেষ কথা

সব শেষে একটাই প্রত্যাশা সবার কাছে বিটিভি ফিরে আসুক সেই সুসময় নিয়ে। তরুণ প্রজন্মের কাছেও বিটিভি হয়ে উঠুক ভালোবাসার নাম। বিটিভির ঐতিহ্য টিকে থাকুক চিরকাল। বিটিভি হোক সব প্রজন্মের দর্শকের আবেগের নাম। জয় হোক বাংলা সংস্কৃতির।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 2 =