মৌ সন্ধ্যা
‘থিয়েটারকে ভালো না বাসলে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমি মনে করি প্রত্যক মানুষকেই শিল্পের সঙ্গে থাকা দরকার। আদর্শ নিষ্ঠাবান নাট্যকর্মী আর পাঁচ-দশটা লোকের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, একজন নাট্যকর্মী যে সমায়নুবর্তিতা, নিষ্ঠা ও শিল্প নিয়ে কাজ করে সে কখনোই কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে না। নাটক নির্ভর করে বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর। শিল্পের যে শিকড় তা বাস্তবে থাকতে হবে। নাটক সমাজ পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখে।’ বছর পাঁচেক আগে এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছিলেন নাট্যজন জামালউদ্দিন হোসেন। একই সঙ্গে এই মানুষটি ছিলেন একজন নির্দেশক ও অভিনেতা। সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো এই গুণী মানুষটি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ করেই সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন জামালউদ্দিন হোসেন। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো শোক ও শ্রদ্ধা। এক সময়ের সাড়া জাগানো এই নাট্যব্যক্তিত্বর সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের অনেকেরই পরিচয় নেই। জেনে নেওয়া যাক এই গুণী মানুষটির এক ঝলক।
জন্মেছিলেন ভারতে
১৯৪৩ সালের ৮ অক্টোবর ভারতের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন জামালউদ্দিন হোসেন। দেশভাগের সময় পরিবারের সবাই চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর থেকে ওখানেই বসবাস শুরু করেন। জামালউদ্দিন হোসেনের স্কুলে কেটেছে চট্টগ্রামের সেন্ট প্ল্যাসিড স্কুলে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসি শেষ করে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বুয়েটের শিক্ষাজীবন শেষে তিনি চট্টগ্রাম স্টিল মিলসে চাকরি শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে অভিনয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা আবুল হায়াত তার সহপাঠী ছিলেন।
নাটকের সঙ্গে এক জীবন
জামালউদ্দিন হোসেন নাটকে অভিনয় করেছেন আবার বেশ কিছু বিখ্যাত মঞ্চ নাটক পরিচালনা করেছেন। তার পরিচালিত বিশেষ নাটকগুলোর মধ্যে আছে; খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, রাজা রানী, চাঁদ বণিকের পালা, আমি নই, বিবিসাহেব, জুগলবন্দী প্রভৃতি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন হোসেন। যে নাট্যগোষ্ঠী ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি তার নিজের নাট্যগোষ্ঠী ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনাসম্বল’ শুরু করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন হোসেন। পরে টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্রেও কাজ করেন। ২০০৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন তিনি। প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। ১১ বছর নিউ ইয়র্ক সিটির বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেছেন। প্রথম আমেরিকাতে যান ১৯৯৪ সালে মেয়ের কাছে। এর পর স্থায়ীভাবে ২০০৬ সালে আমেরিকাতে চলে যান। ব্যক্তিগত জীবনে জামালউদ্দিন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ১৯৬৫ সালে বুয়েট থেকে পাস করে অনেক দিন আধা সরকারি চাকরি করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই নাটকে অভিনয় করতেন। যুক্তরাষ্ট্রে এসেও নাটক ছেড়ে দেননি। মঞ্চেও ছিলেন সক্রিয়। নিউ ইয়র্কে তার স্ত্রী অভিনেত্রী রওশন আরা হোসেনও থাকতেন। নিউ ইর্য়ক সিটিতে অনেকগুলো নাটকের দলের সমন্বয়ে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনাসম্বল’ নামে একটি নাটকের সংগঠন ছিলো। তাদের নানা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন জামালউদ্দিন। প্রতিবছর একটি করে নাটক করতেন। ১১ বছরে প্রায় ১১টি নাটক করেছেন ওই আয়োজনে। এছাড়াও ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও ‘মুক্তধারার’ বই মেলায় তারা স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে ‘বেলাশেষে’ নাটক মঞ্চায়ন করেন। মঞ্চে ২০১৫-১৬ সালেও নিউ ইয়ার্কে নাটক করেছেন। গত সাত বছর ধরে আরও তেমন কাজ করতে পারেননি তারা।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
টিভি নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পেলেও মঞ্চ ছিল জামালউদ্দিন হোসেনের সবচেয়ে ভালোবাসার মাধ্যম। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন। পরে কাজ করেছেন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকেও। শিল্পীজীবনে নিজের কাজের জন্য প্রচুর দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন জামালউদ্দিন হোসেন। অর্জন করেছেন বেশ কিছু পুরস্কারও। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৩ সালে একুশে পদক পান। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে জানতে চাইলে একবার এক সাক্ষাৎকারে জামালউদ্দিন হোসেন বলেছিলেন, ‘জীবনে যা চেয়েছি মনে হয় তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। ধনী না হলেও সম্মান নিয়ে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে একুশে পদক পেয়েছি। আর কি থাকতে পারে? তবে পরজনমে কণ্ঠশিল্পী হতে চাই। আমার প্রচুর দুর্বলতা কণ্ঠশিল্পীদের প্রতি। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত।’
সংসারজীবন
জামালউদ্দিন হোসেন ১৯৭৫ সালে অভিনেত্রী রওশন আরা হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারা উভয়ই নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের শিল্পী ছিলেন, সেখানেই তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। ঐ সময়ে রওশন আরা রেডিওতে নাটক করতেন। বিটিভির একজন কর্মকর্তার রেফারেন্সে রওশন আরার সঙ্গে পরিচয় হয় জামালউদ্দিন হোসেনের। ঐ সূত্র ধরেই পরিচয়, পরিণয় ও পরবর্তীকালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। বিয়ের পরেও সমানতালে অভিনয়ে থাকেন রওশন আরা। স্কুলজীবন থেকে নাটক করতেন তিনি । রেডিওতে নাটক করতেন। সে সময়ে মুসলমান পরিবারে নাটক করা ছিল আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু তার পরিবার ছিল শিল্পমনা। ৬০ এর দশকে রওশনের বাবা তাকে নাটক করা শিখিয়েছেন। বাবা ছিলেন রওশন আরার নাটক জীবনের প্রথম গুরু।
জামালউদ্দিন হোসেন ও রওশন আরা সংসার জীবনে ছিলেন সুখী দম্পতি। তাদের সংসার আলো করে আসে এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে তাফসিন হোসেন তপু ক্যালগেরির মাউন্ট রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। এ ছাড়া তপু দীর্ঘদিন ধরে ‘নাগরিক নাট্যঙ্গন অনাসম্বল’ এর একজন নাট্যকর্মী ও অভিনেতা। তপু ক্যালগেরির স্বনামখ্যাত ‘মুক্ত বিহঙ্গ’ থিয়েটারের হয়ে কাজ করছেন। অন্যদিকে জামালউদ্দিন হোসেনের মেয়েও পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।
ফেরা হলো না তার
যুক্তরাষ্ট্রর আটলান্টা থেকে কানাডায় ছেলে তাশফিন হোসেন তপুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন জামালউদ্দিন হোসেন। সেখানে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তিন সপ্তাহের বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৮১ বছর বয়সে মারা গেলেন অভিনয়শিল্পী জামালউদ্দিন হোসেন। জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা জানান, তার ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে। পরে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলেন না। এরপর গত ২৪ সেপ্টেম্বর শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা দেখা দিলে তাকে তড়িঘড়ি রকিভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেন চিকিৎসকরা। কানাডার রকিভিউ হাসপাতালেই ১১ অক্টোবর নশ্বাস ত্যাগ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত নাট্যজন, নির্দেশক, অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জামালউদ্দিন হোসেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
কানাডাতেই চিরনিদ্রায়
কানাডাতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন নাট্যজন অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন। ২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর আকরাম জুম্মা মসজিদে তার জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে তাকে কক্রেন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় বিভিন্ন কমিউনিটির প্রচুর সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। শেষবারের মতো তাকে এক নজর দেখতে আসেন পরিচিতজনরা। দেশের মিডিয়া অঙ্গনেও পড়ে শোকের ছায়া।
ভালো নেই রওশন আরা
অভিনয়শিল্পী রওশন আরা ও জামালউদ্দিন হোসেনের ৫৯ বছরের দাম্পত্য জীবন। প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া কীভাবে একা একা দিন কাটাচ্ছেন রওশন আরা? তাশফিন হোসেন কানাডার ক্যালগ্যারি থেকে এক গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে ভালো নেই রওশন আরা হোসেনও। তিনি পারকিনসনস রোগে ভুগছেন। তাশফিন হোসেন বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর সময় মা হাসপাতালেই ছিলেন। তার অবস্থাটা এখন এমন, এই মনে থাকে তো এই মনে থাকে না। তাকে নিয়ে তো আমাদের চিন্তার শেষ নেই। বাবা যেমন রোগে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, মা-ও আসলে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা মারা যাওয়ার সময় বাসায় সবার সঙ্গে মা-ও ছিলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন। কাঁদলেনও কিছুক্ষণ। বুঝতে পেরেছেন, আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ অভিনয়শিল্পী দম্পতি রওশন আরা হোসেন ও জামালউদ্দিন হোসেন একসঙ্গে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। গত ১৫ বছর অভিনয়ে একেবারেই অনিয়মিত ছিলেন তিনি। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন। মাঝেমধ্যে যখন দেশে আসতেন, টুকটাক অভিনয় করতেন। তবে সাত-আট বছর ধরে একেবারেই অভিনয়ে ছিলেন না তারা।
শেষ কথা
ভারতের চব্বিশ পরগনায় জন্ম নেওয়া জামালউদ্দিন হোসেন বাংলাদেশে চলে এসেছিলে দেশ ভাগের সময়। এই দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্র। আর মারা গেলেন কানাডায়। গুণী এই মানুষটি বেঁচে থাকবেন তার কাজের মধ্য দিয়ে। ওপারে ভালো থাকুন সবার প্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব জামালউদ্দিন হোসেন।
লেখটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ