বিদায় সাকিব

নিবিড় চৌধুরী

‘বিদায় পরিচিতা/এই বিদায়ের সুর/চুপি চুপি ডাকে/দূর বহুদূর’ বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী কবীর সুমন সেই কবে গেয়েছিলেন এই গান। আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের কিংবদন্তি সাকিব আল হাসানের বিদায় লগ্নে সেই গান আরেকবার মনে পড়ে গেল। কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে যায়, যখন সাকিবের কথা উঠে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার মতো কেউ এসেছেন কি আগে? আসবেন কেউ ভবিষ্যতে?

মাগুরা থেকে উঠে আসা লিকলিকে ছেলেটি আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বকে অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সে এমন বুঁদ করে রাখবেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে, সে কথা কে ভেবেছিল? সাকিব হয়তো ভেবেছিলেন। না ভাবলে যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন না? নামের পাশে তার কত কত রেকর্ড, প্রাপ্তি, ভক্তদের ভালোবাসা; বিতর্কও কি নেই?

ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্ট শুরুর আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিদায় নেবেন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে। যদি দেশে ফিরতে পারেন তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেই অবসর নেবেন সাদা পোশাকের ক্রিকেট থেকে। আর ফিরতে না পারলে কানপুরেই শেষ। সেই কানপুর টেস্ট দুই দিন বৃষ্টির পেটে গেলেও হেরেছে বাংলাদেশ। সাকিব ৪ উইকেট পেলেও নিজের শেষ ইনিংসে আউট হয়েছেন শূন্য রানে। ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটার ডন ব্রাডম্যানও কি ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে ডাক মারেননি! নয়তো অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তির ব্যাটিং গড় ১০০ ছাড়িয়ে যেত। এ ক্ষেত্রে সাকিব সান্ত্বনা খুঁজতে পারেন ব্রাডম্যানের কাছে। কিন্তু দেশে যে এখন তিনি ‘ভিলেন’; ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে, তার সান্ত্বনা কোত্থেকে খুঁজবেন?

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মাগুরা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাকিব। সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছিল তার। কিন্তু গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পাশার দান উল্টে গেছে। সাকিব তখন কানাডায় টি-টোয়েন্টি লিগ খেলছিলেন। তবে আওয়ামী লীগেরে দোসর হওয়ায় শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের পর তার নামেও হয়েছে খুনের মামলা। যার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না ৩৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার। এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারছে না বিসিবিও। ক্রিকেটার সাকিবকে নিরাপত্তা দিলেও রাজনীতিবিদ সাকিবকে নিরাপত্তা দিতে পারছেন না ক্রীড়া উপদেষ্টাও। যার কারণে সাকিবের ঘরের মাটিতে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। সেই সংশয়ের ফলে সবাই ধরে নিয়েছেন কানপুরেই শেষ হয়েছে সাকিবের টেস্ট অধ্যায়।

তবে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে মনে করেন, সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে খেলবেন। এ নিয়ে কানপুর টেস্ট শেষে লঙ্কান কোচ বলেন, ‘আমি শুনিনি যে এটাই তার শেষ টেস্ট। আমি এখন পর্যন্ত জানি সে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ খেলবে। সাকিব না থাকলে কী হবে, সে ভাবনা সব সময়ই থাকে। সে এখন তার ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ে এসে যাওয়ায় এটার পরিকল্পনা থাকেই। তবে সবার মতো আমিও অবাক হয়েছিলাম যখন সে বলল শেষ টেস্টটা সিরিজ হয়তো খেলতে চলেছি। কিছু খেলোয়াড় এমন থাকে, কিন্তু আপনি সাকিবের মতো হুবহু বিকল্প খুঁজে পাবেন না।’

স্বাভাবিকভাবে একটি সিরিজ মানে সাকিবকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ দল চিন্তা করা যায় না। কিন্তু আদৌও কি তিনি দেশে ফিরবেন? কানপুর থেকে সাকিব সরাসরি চলে গেছেন পরিবারের কাছে, যুক্তরাষ্ট্রে। অভ্যুত্থানের পর তাকে আর দেশে দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে খেলেছেন দ্ইু টেস্ট। সেখান থেকে ইংল্যান্ডে গিয়ে একটি কাউন্টি ম্যাচ খেলে সরাসরি আসেন ভারতে। কিন্তু সাকিবের তো এমন যাযাবরের মতো জীবন কাটানোর কথা ছিল না! বিদায়ের দিনে তার ‘গার্ড অব অনার’ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে বিদায় হয়তো কপালে জুটবে না। রাজনীতিতে জড়ানোয় মাশরাফি বিন মর্তুজার ঘর পুড়েছে। সাকিব ফিরতে পারছেন না জন্মভূমিতে। অথচ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে প্রাক্তন বন্ধু তামিম ইকবালক দল থেকে বাদ দেওয়া, শেয়ার কেলেঙ্কারি, রাজনীতি, বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যবসায় না জড়ালে ক্রিকেটার সাকিবকে মাথায় তুলে নাচত মানুষ।

সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আইসিসি অলরাউন্ডারদের শীর্ষে থাকা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭০০-এর বেশি উইকেট, ১৫ হাজার ছুঁইছুঁই রান; বিশ্বে খুব কমসংখ্যক ক্রিকেটারেরই আছে। তার সঙ্গে আইপিএলসহ বিভিন্ন দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজির রান-উইকেট তো আছেই। সাকিব শেষ টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন সীমিত ওভারের এই সংস্করণের বিশ্বকাপে। ভারত সিরিজ দিয়ে হয়তো টেস্টেও শেষ। তবে আগামী বছর চ্যাম্পিয়নশিপসহ মোট ৯টি ম্যাচ খেলে ওয়ানডেকেও বিদায় জানাবেন।

নিজের দেশে বিদায় নিতে না পারলেও ভারত কিংবদন্তি বিরাট কোহলির কাছ থেকে বিদায়ী উপহার পেয়েছেন সাকিব। কানপুর টেস্ট শেষে সাকিবকে নিজের ব্যাট উপহার দিয়েছেন কোহলি। ব্যাট উপহার দিয়েছেন ঋষভ পন্তও। বাংলাদেশের তো বটে, ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সফল, আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত ব্যক্তিটার বিদায়ের ম্যাচে আরও অনেক কিছু প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ সাকিবকে ক্যারিয়ারে অনেক কিছু দিলেও দেশের সমর্থকদের সামনে গৌরবের বিদায়ের স্ক্রিপ্টটা হয়তো লেখেননি।

ব্যর্থতা ভুলে এবার বাংলাদেশের প্রোটিয়া চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের ক্রিকেট এক ধাপ এগোয় তো পেছায় দুই ধাপ। কথাটা মিথ্যা নয়। না হয়, আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার দিকেই দেখুন।

এই তো গত অক্টোবরের শুরুতে, রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশের পর পয়েন্ট তালিকায় ৬ থেকে ৪ নম্বরে উঠে এসেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। এক মাসের ব্যবধানে তাদের ব্যাটে এমন মরচে ধরল, র?্যাংকিংয়েও হলো অবনমন। ভারতের বিপক্ষে কানপুরে সর্বসাকল্যে দুই দিন হওয়া টেস্টে বাজেভাবে হেরে সাত নম্বরে গিয়ে ঠেকেছে বাংলাদেশের পিঠ। তার সপ্তাহখানেক আগে ‘গল’-এ সিরিজ জেতা শ্রীলঙ্কাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাঁচে নেমে গিয়েছিল বাংলাদেশ।

এক ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাসে বুক ফুল উঠে তো পরের দিনই সেই বিশ্বাসের বেলুন ফুটা হয়ে যায় টাইগারদের! সমস্যাটা কোথায়, সেটি নিয়ে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। কিন্তু তারাও বোধ হয় সমস্যা ধরতে পারেননি। শান্ত-লিটনরা নিজেরা কি তাদের সমস্যা ধরতে পেরেছেন? বা চেষ্টা করেছেন সমস্যা সমাধানের? নয়তো কানপুরে অমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন ব্যাটিং কেন! নিশ্চিত ড্র হতে বসা ম্যাচ এভাবেই ফেলে দিল! বিস্ময়কর বটে।

অথচ প্রতিবার হারের পর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে যে আসুক, একটি মুখস্থ কথা বলতেই শোনা যায়, ‘এই ম্যাচ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।’ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার এত দিন পরও যেন সেই শিক্ষা সম্পন্ন হচ্ছে না! তবে কি বাংলাদেশের টেস্ট মানসিকতা এখনও গড়ে উঠেনি?

শান্তদের হাস্যকর হার নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে মজা করতে ছাড়েনি ভারত দলের সমর্থকেরা। কানপুরে শেষ দিনে বাংলাদেশের ড্রয়ের চিন্তা করা নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে রীতিমতো ট্রলই করেছেন ভারতীয়রা। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজারের শিরোনামটা দেখুন, ‘৩০ ঘণ্টার টেস্ট ১৪ ঘণ্টায় জিতে নিল ভারত! দুই রবির স্পিনে ৭ উইকেটে হার বাংলাদেশের’। প্রতিপক্ষ হারলে জয়ী দলের সমর্থকেরা একটু মজা করবেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এখন চিন্তা করতে হবে, হাসির পাত্র হয়ে থাকবে নাকি একটু সিরিয়াস হয়ে উঠবে। তবে এই সিরিয়াসনেস ব্যক্তিগত জীবনে নয়, দেখাতে হবে মাঠের লড়াইয়ে।

পাকিস্তান সিরিজে যারা ভালো করেছিলেন, ভারতে সেটা দেখাতে পারেননি তারা। এই অধারাবাহিতায় বাংলাদেশিদের মূল সমস্যা। কানপুরে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুমিনুল হকের সেঞ্চুরি আর শেষ দিনে মুশফিকুর রহিমের যা একটু লড়াই, বলতে এটুকুই। তার আগে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশি বোলারদের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল। টেস্টে ব্যাট করেছে টি-টেন স্টাইলে। সেটা কিছুটা হলেও থামিয়েছেন সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। দুজনই নিয়েছেন সমান ৪ উইকেট। তবে শেষ পর্যন্ত ভারত যে কৌশলে পয়েন্ট আদায়ের চেষ্টা করেছে, তাতে সফল তারা। ৭ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশকে করেছে হোয়াইটওয়াশ। এর আগে সফরকারীরা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল চেন্নাইতেও।

রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজ জেতার পর সবাই মনে করেছিল, ভারতেও ভালো কিছু করবেন শান্তরা। কিন্তু দুই টেস্টে বাজে হারে উল্টো অবাক ভারতীয়রাই। বাংলাদেশের হতশ্রী পারফরম্যান্সের সমালোচনা করে ভারতের সাবেক ব্যাটার সুনীল গাভাস্কার বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা (বাংলাদেশের ব্যাটাররা) হয়তো ভুলে গিয়েছিল, এটা টেস্ট ম্যাচ। এখানে তো অনেক সময় পাওয়া যায়। এটা তো শেষ দিন ছিল।’  আর ভারতীয় ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের মন্তব্য, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে। টেস্টে নিজেদের সেরা সময়ে থাকতেই এখানে (ভারত) এসেছিল। কয়েকটা ভালো দলের বিপক্ষে ঘরের মাঠে তারা (বাংলাদেশ) জিতেছে। পাকিস্তানকে তাদের দেশে হারানো তো অনেক বড় অর্জন।’

এমন হারে হতাশ বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও। কানপুর টেস্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘এই হার আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। ভারতের এমন অ্যাপ্রোচ আমরা আগে দেখিনি। রোহিত ও ওর দলকে কৃতিত্ব দিতেই হবে, এমন অ্যাপ্রোচে ম্যাচ জয়ের জন্য। আমাদের পারফরম্যান্স মেনে নেওয়া কঠিন।’

ভারতে ব্যর্থতা ভুলে বাংলাদেশকে এবার চোখ দিতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ঘরের মাটিতে এটিই প্রথম সিরিজ শান্তদের। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ থেকে নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সরে চলে গেছে আরব আমিরাতে। ৯ বছর পর সফরে আসা প্রোটিয়াদের বিপক্ষে এখন দুই ম্যাটের টেস্ট সিরিজ আয়োজন বড় চ্যালেঞ্জ বিসিবির জন্য। আর শান্তদের চ্যালেঞ্জ জয়ের ধারায় ফেরা।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সাকিব আল হাসানকে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তার জন্য মিরাজকে ব্যাটিং অর্ডারে তুলে আনতে হবে ওপরের দিকে। আর ওপেনিংয়েও আনা যেতে পারে পরিবর্তন। পেস ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে নাহিদ রানাকে। তবে বাংলাদেশের উইকেট হয় সবসময় স্পিননির্ভর। সেক্ষেত্রে তাইজুল ইসলামকে দিতে হবে স্পিন ইউনিটের নেতৃত্ব। আর সাফল্য পেতে শান্তকে মাথাটা করতে হবে আরও তীক্ষ্ণ। রিভিউ নেওয়ার সময় আরও দক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন তার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 + 2 =