বিদ্যুৎ খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে বিপিডিবি বছরে ১২০ কোটি ডলার সাশ্রয় করতে পারে

বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বোঝা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সরকারকে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে

সারসংক্ষেপ:

১.  ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত  বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ‍উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১২৫% বাড়লেও, শ্লথগতিতে বিদ্যুতের চাহিদাবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যের জ্বালানির ব্যবহার, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সীমিত সাফল্য এবং প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

২. ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক ১.৮ গুণ রাজস্ব বৃদ্ধির বিপরীতে বিপিডিবির বার্ষিক মোট ব্যয় ২.৬ গুণ বেড়েছে, যার দরুন সরকারকে এই বছরগুলোতে সর্বসাকুল্যে এক লাখ ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (১০৬৪ কোটি মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিতে হয়েছে।

৩. বিদ্যুৎ খাতের রিজার্ভ মার্জিন (সংরক্ষিত উৎপাদন সক্ষমতা) সম্ভবত এই ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৬.১%-এ পৌঁছাবে –  সীমিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত থাকায়, এই রিজার্ভ মার্জিনকে বাংলদেশের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বলা যায়। আইইইএফএ-র মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ২৫ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারে, এর জন্য ৩৫ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতাই যথেষ্ট ।এতে করে রিজার্ভ মার্জিন ৩৬.৪% এ নেমে আসবে ।

৪ ডিসেম্বর ২০২৪ (আইইইএফএ দক্ষিণ এশিয়া) –  বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বছরে তাদের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (১২০ কোটি ডলার) কমিয়ে আনতে পারে যা এ খাতে সরকার প্রদত্ত বাৎসরিক ভর্তুকি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল এনালিসিসের (আইইইএফএ) নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।

ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে মেটানো শিল্পখাতের চাহিদার অর্ধেক গ্রিডের বিদ্যুৎ দিয়ে মিটিয়ে, নতুন ৩ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত করে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হওয়া লোডশেডিং এর পরিমান ৫%-এ নামিয়ে এনে এবং সরবরাহ ও বিতরণে অপচয়ের পরিমাণ ৮%-এর মধ্যে সীমিত রেখে বাংলাদেশ এই অর্থ বাঁচাতে পারে, বলা হয়েছে এ গবেষণা প্রতিবেদনে।

“অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের রিজার্ভ মার্জিন ৬১.৩% যা প্রমান করে আমাদের মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে; অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতার জন্যেই বিপিডিবির ভর্তুকির বোঝা ক্রমে ভারি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করার পরও, অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতার কারণে নিকট ভবিষ্যতেও এ খাতে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতি ও ভর্তুকি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আইইইএফএ-র প্রস্তাবিত রোডম্যাপে, ভবিষ্যতে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা কমাতে বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলনে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে,” বলেছেন গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখক এবং আইইইএফএ-র বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম।

“আমাদের রোডম্যাপে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নতুন বিনিয়োগ কমিয়ে এনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, শিল্প-কারখানাগুলোকে গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভকেন্দ্র চালানোর বদলে গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক গ্রিডের আধুনিকায়ন ও লোডশেডিংয়ের মাত্রা সীমিত পর্যায়ে আনারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরণের ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে, এ খাতে ভর্তুকির বোঝা কমবে যা আমাদের মূল্যায়নে উঠে এসেছে,” বলেছেন আলম।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক ১.৮ গুণ রাজস্ব বৃদ্ধির বিপরীতে বিপিডিবির বার্ষিক মোট ব্যয় ২.৬ গুণ বেড়েছে; ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে, সরকারকে এই বছরগুলোতে সবমিলিয়ে ভর্তুকি দিতে হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (১০৬৪ কোটি মার্কিন ডলার)। তা সত্ত্বেও, এ পাঁচ অর্থবছরে বিপিডিবির সর্বমোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা (১৯৯ কোটি মার্কিন ডলার) ।

কেবল ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই সরকার বিপিডিবিকে ৩৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।

এই ভর্তুকির পরিমান শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে শিল্পকারখানাগুলোকে পুরোপুরি জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন শফিকুল আলম।

“পাশাপাশি, বাংলাদেশের উচিত গ্যাসচালিত যন্ত্রপাতি সমূহ থেকে ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে স্থানান্তরিত হওয়া (যেমন গ্যাসচালিত বয়লার এর পরিবর্তে ইলেকট্রিক বয়লার ব্যবহার করা)। ফলে, বিপিডিবি বাড়তি বিদ্যুৎ বিক্রি করে রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) কমাতে পারবে,” বলেছেন আলম।

“সম্ভাবনা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে এলেও, উপযুক্ত রোডম্যাপ অনুসরণ করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে টেকসই করার সুযোগ এখনও রয়েছে,” যোগ করেন আলম।

সংস্কারের প্রথম ধাপে, ২০২৫ সাল থেকে বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলনে, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিল্প কারখানার চাহিদা গ্রিডের বিদ্যুৎ দিয়ে মেটানোর পদক্ষেপকে বিবেচনায় নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে নতুন এ গবেষণা প্রতিবেদনে। এ ধরনের সূচক বিবেচনায় নিয়ে আইইইএফএ-র প্রাক্কলনে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ২৫ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট; অন্যদিকে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রস্তুতকৃত সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, এই চাহিদা থাকার কথা ২৭ হাজার ১৩৮ থেকে ২৯ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াটের মধ্যে।

পাশাপাশি, আইইইএফএ-র রোডম্যাপে নতুন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ বন্ধ এবং তেল-চালিত কেন্দ্রগুলোর ব্যবহার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫% এর মধ্যে সীমিত করে আনারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি যদি সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াটের জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক পুরোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হলেও, বাংলাদেশের ৩৫ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকবে বলে প্রতিবেদনে ধরা হয়েছে (নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ)।

“৩৫ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা ২০৩০ সালে বাংলাদেশের ২৫ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট পরিমান সর্বোচ্চ চাহিদা সহজেই পূরণ করবে। এতে করে, রিজার্ভ মার্জিন ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৬৬.১% তে পৌঁছলেও, ২০৩০ সালে ৩৬.৪% (নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎসহ) ও ২০% (আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল এমন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ বাদ দিয়ে) তে নেমে আসবে। প্রাক্কলিত এ রিজার্ভ মার্জিন ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর সঙ্গে তুলনীয়,” বলেছেন আলম।

শেষে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের ৩৫ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে মোট সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত সমন্বিত গ্রিড-সংযুক্ত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা স্থাপনের রক্ষণশীল লক্ষ্যকে বিবেচনায় নিতে পারে; এই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ দিনের বেলায় ব্যয়বহুল তেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার কমাতে সহায়তা করবে। প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত ৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে তিন ঘন্টার ব্যাটারি স্টোরেজ রাতেও তেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার কমিয়ে আনবে। আর ভবিষ্যতে যদি ব্যাটারির দাম আরও কমে, রাতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদার সময়, বাংলাদেশ এর বর্ধিত ব্যবহারের কথাও চিন্তা করতে পারে।

“বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সফলতা নির্ভর করবে দেশটি এ বিষয়ে কতখানি অনুকূল নীতিমালা তৈরী করবে, জিডিপি এর প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে জ্বালানির দক্ষতা বৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্ত করবে কিনা; এর পাশাপাশি, গ্রিড আধুনিকায়নের মতো বিষয়ের ওপর নজর দেয়া, শিল্পকারখানাকে গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রসারে প্রতিবন্ধকতাসমূহকে দূর করতে হবে,” বলেছেন শফিকুল আলম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 13 =