বিপিএলের অভিজ্ঞতা কাজে আসবে তো চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে

নিবিড় চৌধুরী

জমকালো আয়োজন, রান বন্যার ম্যাচ, শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই, দর্শক ধরে রাখার মতো আমেজে শেষ হয়েছে ২০২৫ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। তবে চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে তেমনি কালিমা লেগেছে এবারের সংস্করণেও। উঠেছে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ। বেতন-ভাতা নিয়ে হয়েছে নানা নাটকীয়তা। ঘটেছে ম্যাচ বয়কটের মতো লজ্জাজনক ঘটনা। সে যাই হোক, এসবের মাঝেই  আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে বিপিএলের ১১তম আসরে জুতসই প্রস্তুতি সেরেছে বাংলাদেশ দলের ১৫ ক্রিকেটার।

১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু বহুল প্রতীক্ষিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। করাচিতে উদ্বোধনী ম্যাচ স্বাগতিক পাকিস্তানের সঙ্গে নিউ জিল্যান্ডের। হাইব্রিড মডেলের টুর্নামেন্টে বিকল্প ভেন্যু হিসেবে থাকছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিপিএলে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের নান্দনিক পারফরম্যান্সের কারণে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নতুন স্বপ্ন দেখছেন দেশের ক্রীড়ামোদীরা। তার আগে আরেকবার দেখে নেওয়া যাক বিপিএলে মেহেদি হাসান মিরাজ-তাসকিন আহমেদদের সাফল্য ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তারা দলের জন্য কেমন ভূমিকা রাখতে পারেন।

মেহেদী হাসান মিরাজ

ব্যাট-বলে ফুল প্যাকেজ যাকে বলে! বিপিএলে ক্যাপ্টেন্সিও করেছেন নিঁখুতভাবে। সেই সুবাদে কোয়ালিফায়ার পর্যন্ত ওঠে খুলনা টাইগার্স। শেষ বলের নাটকীয়তায় চিটাগং কিংস না জিতলে ফাইনাল খেলতো তারা। তবে ফাইনাল খেলতে না পারলেও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতেছেন খুলনার দলনেতা  মিরাজ। বাংলাদেশ দলে এখন নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডারের একজন তিনি। সাকিব আল হাসান না থাকায় তার ওপরে বর্তাবে অনেক দায়িত্ব। পাকিস্তান শাহীনসের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে হারলেও চারে ব্যাটিংয়ে নেমে খেলেছেন দলীয় সর্বোচ্চ ৪২ রানের ইনিংস। দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেটে টিকে থাকা, বল হাতে ব্রেক থ্রু এনে দেওয়ার সবই পারেন মিরাজ। এমনকি তাকে ‘মেক-শিফ্ট’ ওপেনার হিসেবেও খেলানো যেতে পারে। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তাকে দেখা যাবে সাকিবের পজিশনে।

তানজিদ হাসান তামিম

চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলে থাকা বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে বিপিএলে ব্যাট হাতে সবচেয়ে সফল তানজিদ। তার দল ঢাকা ক্যাপিটালস সুবিধা করতে না পারলেও ঠিকই দ্যুতি ছড়িয়েছেন এই বাঁহাতি ওপেনার। সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারও জিতেছেন।

সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তামিমের অবস্থান দুই নম্বরে। চারটি ফিফটির সঙ্গে একটি সেঞ্চুরিও করেছেন তিনি। তামিম সেই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দারুণ সূচনা পাবে বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের উত্তরসূরি হিসেবে দলে আসা তার। যুব বিশ্বকাপ জেতার সাফল্য আছে তানজিদের। খেলে ফেলেছেন এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ। তবে বড় মঞ্চে তেমন ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। এবার সেই আক্ষেপ গোছানোর সময়।

তাসকিন আহমেদ

বিপিএলে ১২ ইনিংসে ২৫ উইকেট নিয়ে  সেরা বোলারের পুরস্কার জিতেছেন তাসকিন। তার মধ্যে এক ম্যাচে সাত উইকেট নিয়ে গড়েছেন রেকর্ড। দুর্বার রাজশাহীকে শেষ পর্যন্ত সেরা চারে ওঠানোর আশা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাসকিনের অবদান সবচেয়ে বেশি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তাসকিনই থাকবেন বাংলাদেশ দলের পেস ইউনিটের নেতৃত্বে। নতুন রূপে বিপিএলে খেলা তাসকিন ভালো উইকেট পেলে দিনটা নিজের করে নিতে চাইবেন।

মুশফিকুর রহিম

বিপিএল সেরা ফিল্ডারের পুরস্কার জিতেছেন ফরচুন বরিশালের উইকেটরক্ষক ব্যাটার মুশফিক। আসরজুড়ে উইকেটের পেছনে ১২টি ক্যাচ ও ২টি স্টাম্পিং করেছেন। সেরা ফিল্ডার হলেও ব্যাট হাতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি মুশি। ১৪ ম্যাচে ২৬ গড় ও ১২৮ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১৮৪ রান। তবে অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে। সেটি মুশফিকও ভালো করে জানেন। উইকেটের পেছনে তো বটে, মিডল অর্ডারে বাংলাদেশের বড় ভরসা তিনি। প্রস্তুতি ম্যাচে ব্যাট হাতে ভালো করতে না পারলেও চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজের সেরাটাই দিতে চাইবেন মুশি। সেই ধারাবাহিকতা তিনি আগেও দেখিয়েছেন।

তাওহীদ হৃদয়

বিপিএলের এবারের আসরের শুরুতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে তাওহীদের ব্যাটে। তবে ক্রমেই স্বরূপে ফেরেন তিনি। ওপেনিংয়ে  বরিশালের ওপেনার তামিম ইকবালের সঙ্গে তার রসায়নও ছিল দুর্দান্ত। ১৪ ম্যাচে হৃদয়ের ব্যাট থেকে এসেছে ৩১২ রান।  চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশের সমর্থকেরা। মিডল অর্ডারে বাংলাদেশকে সামলাতে হবে তাওহীদকেই।

সৌম্য সরকার

চোট ও সৌম্য যেন সমার্থক। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসরে তার ব্যাটিংয়ের জাদু দেখার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় ভক্তদের। কিন্তু সৌম্য খেলতে পারেননি বেশি ম্যাচ। সুযোগ হয়েছে মাত্র চারটিতে ব্যাট করার। এতে সর্বোচ্চ ৭৮ রানের ইনিংস রয়েছে সৌম্যর। আর ৪ ম্যাচে করেন ১০৫ রান। লিটন দাস না থাকায় ওপেনিংয়ে সৌম্যকে আলাদা দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। দেখাতে হবে ধারাবাহিকতা। প্রতিভাবানের খোলস ছেড়ে সিনিয়র হিসেবেই সৌম্যকে ব্যাটিংয়ে সৌম্যকান্তি দেখাতে হবে এবার।

নাজমুল হাসান শান্ত

যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলবে, সেই নাজমুল হাসান শান্ত যেন এবারের বিপিএল ভুলে যেতে চাইবেন। কেননা ব্যাট হাতে নিজেকে খুঁজেই পাননি এই বাঁহাতি ব্যাটার। তারই ফলস্বরূপ মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলার পর একাদশেও জায়গা হয়নি শান্তর। বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের এমন ছন্দপতনে স্বাভাবিকভাবে দুশ্চিন্তায় বিসিবি থেকে পুরো বাংলাদেশি সমর্থকরা। প্রস্তুতি ম্যাচে চেষ্টা করলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা ঢেকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জ্বলে উঠতে পারবেন তো শান্ত? তার যে অনেক দায়িত্ব!

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ

বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরীক্ষিত সৈনিক। বিপিএলেও মাহমুদউল্লাহ ছিলেন স্বরূপে উজ্জ্বল। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় সেরাদের কাতারে জায়গা করে নিতে না পারলেও নিজের অবস্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা। ফরচুন বরিশালের এই মিডল অর্ডার ব্যাটার ১৪ ম্যাচ খেললেও ব্যাট করেছেন মাত্র ৮টিতে। তাতেই দুটি ফিফটি করেন       ‘সাইলেন্ট কিলার’ খ্যাত রিয়াদ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তাকে দেখা যাবে ছয় বা সাত নম্বরে ব্যাট করতে। লেট মিডল অর্ডারে নেমে ইনিংস বড় করার দায়িত্ব থাকবে মাহমুদউল্লাহর কাঁধে। দেখাতে হবে বুড়ো হাড়ের ভেলকি। বাংলাদেশকে অনেক অবিস্মরণীয় জয় উপহার দিয়েছেন তিনি। তাই তার প্রতি প্রত্যাশাও থাকবে বেশি। হয়তো এটিই হতে পারে মাহমুদউল্লাহর শেষ আইসিসি টুর্নামেন্ট। বড় টুর্নামেন্টে তার রেকর্ড ভালো। শেষের আগে বাংলাদেশ দলকে আরেকটি স্মরণীয় মুহূর্ত এনে দেওয়ার আশায় থাকবেন এই অলরাউন্ডারও।

জাকের আলী অনিক

পাওয়ার হিটার তকমা পাওয়া জাকের আলী বিপিএলে খানিকটা হতাশ করেছেন ভক্তদের। ১২ ম্যাচে ফিফটি পেয়েছেন মাত্র একটিতে। সিলেট স্ট্রাইকার্সের প্রয়োজনের সময়েও জ্বলে উঠতে পারেননি। ১২৭ স্ট্রাইক রেট ও ২৪ গড়ে জাকের করেন ২৪১ রান। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেই ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলতে হবে তাকে। এসেই খুব দ্রুত বাংলাদেশ দলে জায়গা করে নিয়েছেন জাকের। জায়গা পাকাপোক্ত করতে চাইলে মিডল অর্ডারে হতে হবে ধারাবাহিক। ইতোমধ্যে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তার। আরেকটি আইসিসি টুর্নামেন্টে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর বড় কিছু করে দেখানোর সময় এখন জাকেরের।

পারভেজ হোসেন ইমন

নির্ভরযোগ্য ওপেনার লিটন দাসকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা করে নিয়েছেন পারভেজ হোসেন ইমন। চিটাগং কিংস তারকার এবারের বিপিএলের শুরুটা ছিল হতাশার। তবে ক্রমেই ছন্দে ফেরেন ইমন। ১৩ ম্যাচে ১৩০ স্ট্রাইক রেট ও ২৮ গড়ে করেন ৩৩৮ রান। ওপেনিংয়ে তানজিদ ও সৌম্য থাকায় চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তার খেলার সুযোগ না-ও আসতে পারে। তবে এলে সেই সুযোগ লাগাতে হবে।

রিশাদ হোসেন

বিপিএলের ফাইনালের শেষ দুই ওভারে ম্যাচ যখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে, তখনই ফরচুন বরিশালের ত্রাতারূপে আবির্ভাব রিশাদ হোসেনের। শেষ দুই ওভারে তার হাঁকানো দুই ছয়ে সহজ জয় পায় বরিশাল। অথচ শুরুর দিকে তারকায় ঠাসা দলের একাদশে জায়গা হচ্ছিল না রিশাদের। তবে সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এখন তাকে নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করতে হবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। মূলত স্পিনার হলেও ব্যাটিংটাও ভালো পারেন রিশাদ। বড় হিটও করতে পারেন।

মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসার মোস্তাফিজুর রহমান খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি বিপিএলে। ১২ ম্যাচে নিয়েছেন ১৩ উইকেট। তবে এখন কন্ডিশন পুরোই ভিন্ন। কাটার মাস্টারের বোলিংয়ে আগের সেই ধার নেই বটে, তবে অভিজ্ঞতার বড় দাম তো আছেই। বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সাফল্য আরেকবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দেখাতে হবে তাকে।

নাসুম আহমেদ

বিপিএলে ১২ ম্যাচে  ১৩ উইকেট নেন স্পিনার নাসুম আহমেদও। প্রতি ওভারে খরচ করেছেন ৭.২৫ রান, গড় ১৬.১৫। ব্যাট হাতে ২৮ রান রয়েছে নাসুমের। তবে নাসুমকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলে নেওয়া কন্ডিশন ও ফরম্যাট বিবেচনায়। সেই আস্থার প্রতিদান তিনি দিতেও চাইবেন।

তানজিম হাসান সাকিব

বাংলাদেশ দলের উদীয়মান পেস বোলারদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান তানজিম হাসান সাকিব ছিলেন দুর্দান্ত। দ্রুত গতির বল ও দুর্দান্ত সুইংয়ের মাধ্যমে বারবার ব্যাটারদের করেছেন পরাস্ত। মাত্র ৯ ম্যাচে বল হাতে নিয়েছেন ১৬ উইকেট।

নাহিদ রানা

দ্রুত গতিতে বল করে অল্প সময়ের মধ্যে ভক্তদের মন জয় করা নাহিদ রানার বিপিএলটাও মন্দ ছিল না। এবারের আসরে নিয়েছেন ১০ উইকেট। পাকিস্তানের পেসবান্ধব উইকেটে যদি গতির ঝড় তুলতে পারেন তবে ব্যাটারদের অবস্থা খারাপ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। রানা সেটিই করতে চাইবেন।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের এবারের আসর যেমন আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, তেমনি দেশের ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সও আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে তরুণ ক্রিকেটারদের উত্থান এবং সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে দলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। যদিও কিছু খেলোয়াড় ছন্দ হারিয়েছেন, তবে সামগ্রিকভাবে পারফরম্যান্স ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এই আত্মবিশ্বাস কতটা কাজে আসে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা!

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 + 20 =