নিবিড় চৌধুরী
সিলেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে মাহিশ পাথিরানার গতি কাজে লাগিয়ে র্যাম্প শটে উইকেটরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে জাকের হোসেন অনিক যে ছক্কাটি মেরেছিলেন, নিশ্চিত সেই দৃশ্য অনেকদিন মনে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। আর কী কী মনে থাকবে? রান তাড়ায় লম্বা সময়ের পর টি-টোয়েন্টিতে ফেরা ‘বুড়ো’ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বিধ্বংসী ইনিংসটিও ভোলার নয় নিশ্চয়! মাহমুদউল্লাহ-জাকের আরেকটি জিনিসও বুঝিয়ে দিলেন। এতদিন যারা বলতেন, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ব্যাটিং ঠিক টি-টোয়েন্টিসুলভ নয় তারাও মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন এ দুই মিডল অর্ডার ব্যাটারের প্রায় প্রায় দুইশ’র কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটের ব্যাটিং। ম্যাচটিতে বাংলাদেশ হেরেছে ৩ রানে। তবে আমাদের ক্রিকেটের নতুন প্রাপ্তি অনিক।
তিনি কি ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে পারবেন, নাকি নাসির হোসেন-সাব্বির রহমানদের মতো শুরুতেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে অকালেই হারিয়ে যাবেন? সেটি জানা যাবে ভবিষ্যতে। আপাতত আমাদের চাওয়া, সিলেটের এই ‘লোকাল হিরো’ই হয়ে উঠুক বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মিডল অর্ডারের আশা-ভরসা। স্বস্তির বিষয় হলো, মাহমুদউল্লাহ থাকতেই তার পজিশনে জাকেরকে পাওয়া। এই জাকেরকেই ভাবা হচ্ছে ‘সাইলেন্ট কিলার’ মাহমুদউল্লাহর উত্তরসূরি। সেটি প্রমাণের জন্য আরও অনেক কিছু করে দেখাতে হবে জাকেরকে। আমাদের সদ্য সমাপ্ত বিপিএলের উপহার তিনি। ভারতের শুবমান গিল, যশস্বী জয়সওয়াল, রিংকু সিংদের মতো অনেক তারকা উঠে এসেছেন আইপিএল খেলে। সেখানে বিপিএল খেলে আমাদের দেশে ক’জন উঠে আসেন?
এক সময় আইপিএলের পরে উচ্চারিত হতো বিপিএলের নাম। কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। পিএসএল, সিপিএল, এসএ২০-সহ অনেক দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সে জায়গায় হিসেব কষতে হবে, বিপিএল আমাদের কী দিচ্ছে। নাকি এমনিতে একটি টুর্নামেন্ট করা দরকার বলে করা হচ্ছে, নাকি ভিন্ন কিছু; সেসবই আজ আমরা ভেবে দেখব।
গত ১ জুন শেষ হলো দেড় মাস ধরে চলা ১০তম বিপিএল। মিরপুরে গত দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন লিটন দাসদের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসকে হারিয়ে তামিম ইকবালের নেতৃত্বে প্রথমবার শিরোপা জিতেছে ফরচুন বরিশাল। এর তিন দিন পরই শুরু শ্রীলঙ্কা সিরিজ। সেই সিরিজে বিসিবি যে দল দিয়েছিল তাতে ছিলেন না জাকের। সিরিজের আগমুহূর্তে আরেক তরুণ আলিস ইসলাম চোটে ছিটকে গেলে কপাল খুলে তার। তবে শুরু থেকে জাকেরকে দলে না নেওয়ায় বিসিবির কর্মকর্তাদের একহাত নেন কুমিল্লার কোচ সালাহ উদ্দিন। জাকেরকে তিনিই যে সবচেয়ে বেশি ভালো চেনেন। তার অধীনে ছিলেন এবারের বিপিএল তারকা ২৬ বছরের এই তরুণ। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ কোচ সালাহ উদ্দিন সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তরুণদের মধ্যে যে কজন ফিনিশার তার নজর কেড়েছে তার মধ্যে জাকের অন্যতম। সেটির প্রমাণ তো পাওয়ায় গেল।
আগামী জুনে প্রথমবারের মতো মার্কিন মুলুকে (যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) বসতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। তার আগে জাকেরের মতো একজন পাওয়ার হিটার তরুণকে পাওয়া নিঃসন্দেহে দেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় স্বস্তির। তবে বাকিরা বিশ^কাপকে সামনে রেখে কতদূর প্রস্তুতি নিল? বিপিএল দিয়ে তার এক প্রকার ‘রিহার্সেল’ হয়ে গেল। সেখানে ‘লেটার মার্ক’ দেওয়া যাচ্ছে না কাউকে। কারণ, যে ধরনের প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা, সেটি হয়নি। শুধু তামিম ইকবাল-সাকিব আল হাসান ‘ডার্বি’ যা একটু রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে। সেটি ম্যাচের চেয়েও বেশি দেশের দুই সেরা তারকার অতীত কর্মকাণ্ড ও কোন্দলের কারণে। সেখানে অবশ্য পাস করেছেন তামিম। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে সাকিবের রংপুর রাইডার্সকে হারায় তামিমের বরিশাল। দুই দলের এর আগের ম্যাচে সাকিবকে ব্যাঙ্গ করে তামিমের উদযাপন নিয়ে তো বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। তামিম এবারের বিপিএলে করেছেন সর্বোচ্চ ৪৯২ রান। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারও জিতেছেন তিনি। কিন্তু দেশসেরা এই ওপেনারের এমন পারফরম্যান্স হয়তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেখা যাবে না। গত বছরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণে আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
৪৬২ রান নিয়ে তামিমের পরে আছেন কুমিল্লার তাওহীদ হৃদয় ও চারে থাকা চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের তানজিদ হাসান তামিমের রান ৩৯১। এ দুজনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা প্রায় নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায়, যদি সৌম্য সরকারের ব্যাট না হাসে। কিন্তু হৃদয় ও তানজিদ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। প্রথমবার বড় মঞ্চে গিয়ে দুজনে ব্যাটিংই ভুলে গিয়েছিলেন। তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দলে আসা মাহমুদউল্লাহই যা একটু পারফরম্যান্স করেছেন। কিন্তু এই অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারকে গত কেন্দ্রীয় চুক্তিতে ছিলেন না। তারপরও অনেকে ভাবছেন, যে ফর্মে আছেন সেটি ধরে রাখতে পারলে শেষ বিশ্বকাপটা খেলা হতে পারে মাহমুদউল্লাহ। তবে জাকের যদি ধারাবাহিক হন তবে নির্বাচকেরা ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেন।
গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে ওপেনিং সমস্যায় ভুগেছে বাংলাদেশ। তামিমের পরিবর্তে এসে তানজিদ কিছুই করে দেখাতে পারেননি। লিটনও পারেননি জ্বলে উঠতে। এবারের বিপিএলে অবশ্য তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৯১ রান করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে প্রথম ওয়ানডেতে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় ম্যাচে কিছুটা স্বরূপে ফেরার আভাস দিয়েছিলেন। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওপেনিংয়ে তানজিদ নাকি সৌম্য – কে হবেন লিটনের সঙ্গী সেটিই এখন দেখার। গত নিউ জিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজে সৌম্য বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে ফের দলে ফিরেছেন। বিপিএলে অবশ্য তিনি ধারাবাহিক ছিলেন সেটি বলা যাবে না। ১৫ ম্যাচে নিয়েছেন ২৬৭ রান। লঙ্কানদের বিপক্ষে জ¦লে উঠতে না পারলে সৌম্যের জায়গা পাওয়া আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বকাপে ফিট সাকিবকে পাওয়া যাবে তো? চোখের সমস্যার কারণে বিপিএলে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেননি তিনি। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দেখা যায়নি তাকে। তবে বিপিএলে রাউন্ড লিগের শেষ দিকে ঠিকই পুরানো সাকিবকে দেখা গেছে। কোয়ালিফায়ারের দুই ম্যাচে অবশ্য কিছুই করতে পারেননি। তবে ব্যাট হাতে ২৫৫ রান ও বল ঘুরিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরার অন্যতম দাবিদার ছিলেন তিনি। তারুণ্যনির্ভর দলের সঙ্গে সাকিবের বিশ্বকাপে থাকা নিশ্চিতভাবে অনেক সাহস ও শক্তি যোগাবে বাকিদের। চোখের সমস্যা নিয়ে অবশ্য ভাবছেন না সাকিব। এ নিয়ে একবার সংবাদ সম্মেলনেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন তিরিন, ‘আপনাদের চেয়েও ভালো দেখি’।
প্রথমবারের মতো তিন সংস্করণের নেতৃত্ব পেয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত ব্যাটিং ভুলে গেছেন, এমন কথাটা কদিন আগেও খুব জোরেশোরে শোনা গেছে। কারণ, বিপিএলে শান্তর ‘শান্ত ব্যাটিং’। তবে লঙ্কানদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে জয় এনে দেওয়া ব্যাট করেছেন তিনি। বোলিংয়ে অবশ্য একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যাচ্ছে। সেই কিন্তুটা মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে। বিপিএলের সঙ্গে লঙ্কা সিরিজেও খোলসবন্দি ছিলেন তিনি। পেস আক্রমণে শরীফুল ইসলাম ও তাসকিন আহমেদ অবশ্য ফর্মে আছেন। দুর্দান্ত ঢাকাকে প্লে অফে নিয়ে যেতে না পারলেও ১২ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে শরীফুলই এবারের বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। নতুন বল হাতে বেশ তোপ দাগাতে পারেন তিনি। আর তাসকিন যদি ফিট থাকেন তবেই হলো।
এ হলো আরেকটি বিশ্বকাপের আগে বিপিএল দিয়ে আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি। তাহলে বিপিএল কেমন গেল? সেটি খোদ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মুখ থেকে শুনুন, ‘আমাদের যথাযথ কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট নেই। এটা শুনতে অদ্ভূত লাগবে। তবে বিপিএল যখন দেখি, মাঝেমধ্যে টিভি বন্ধ করে দিই। কিছু খেলোয়াড় তো কোনো মানেরই নয়। এই চলমান পদ্ধতি নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে।’ গত ফেব্রুয়ারিতে ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিপিএল নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এমনটাই বলেছিলেন বাংলাদশে ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ। অবশ্য দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ও বিসিবির কর্মী হয়েও তার এমন কথা শুনে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছিলেন, হাথুরুর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে হাথুরুর এই কথা নির্জলা সত্য। কয়েক বছর ধরে বিপিএল যেন বুড়ো বলদ দিয়ে হাল চাষের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষ্প্রাণ এক টুর্নামেন্ট। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম; এ তিন পর্বে যা একটু দর্শক ছিল সিলেট ও চট্টগ্রামে। ঢাকা পর্বের মধ্যে প্লে অফ শুরু হতেই মিরপুরে দর্শকদের আনাগোনা বেড়েছে। ফাইনালে তো টিকিট পেতে কাড়াকাড়িও শুরু হয়। এসব কিছু এটাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষ এখনো ক্রিকেট ভালোবাসে। তবে এর আগের ম্যাচগুলোতে নিষ্প্রাণ ও দর্শকশূন্য গ্যালারি কেন দেখা গেল?
প্রচারের অভাব নাকি ফ্লাডলাইটের আলোয় বসন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় ক্রিকেট তৃপ্ত করতে পারেনি দর্শকদের। আয়োজকদের ঢিলেমি, ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পেশাদারিত্বের অভাব তো আগের লেখাতেও বলেছি। অন্যান্য টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে তারকাদের ঢল দেখা গেলেও বিপিএলে সেই আলো কই! বড় তারকাদের মধ্যে এবার এসেছিলেন পাকিস্তানের বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান ও শোয়েব মালিক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল ও সুনীল নারিন। ইংল্যান্ডের মঈন আলী, নিউ জিল্যান্ডের জিমি নিশাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার। তবে তাদের কেউ পুরো টুর্নামেন্ট খেলেননি। কেউ শুরুতে কয়েক ম্যাচ খেলে চলে গেছেন, কেউ শেষদিকে কয়েকটা ম্যাচ খেলতে এসেছিলেন। যার কারণে ফাইনালে দেশি তারকাদের ছাড়া বাইরের কাউকে তেমন দেখা যায়নি। একই সময়ে বেশ কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট হওয়ায় এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তবে জাঁকজমক ও দর্শক টানার ক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলো এগিয়ে গেলেও বিপিএল পিছিয়ে পড়ছে। বিপিএলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম, এমনটাই শুনতে হচ্ছে সর্বত্র। প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হলে ম্যাচে রোমাঞ্চ ছড়াবে না। আর রোমাঞ্চ না ছড়ালে দর্শক টানাও কঠিন হয়ে যাবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ