বিশ্বাস করতাম আমিই দুরু: সুমু

তার পুরো নাম জিন্নাত আরা। ডাকনাম সুমু। মা সুফিয়া বেগম ও বাবা জাবেদ আলী খান শিল্পমনা মানুষ। সুমু বেড়ে উঠেছেন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। বড় বোনের কাছে পেয়েছিলেন নাচ শেখার অনুপ্রেরণা। সুমু এক বছর নাচ শিখেছিলেন ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে। মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘সিনপাট’। এর আগে একেবারেই আনকোরা অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে ‘শাটিকাপ’ বানিয়ে চমকে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত সে সিরিজটির পর ভক্ত-দর্শকদের অপেক্ষা ছিল তার পরের কাজ দেখার। অবশেষে চরকিতে মুক্তি পেয়েছে ‘সিনপাট’। এই সিনেমা ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে সিনেমাটির নায়িকা জিন্নাত আরা সুমু কথা বলেছেন রঙবেরঙের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুম আওয়াল

প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের অনুভূতিটা কেমন

‘সিনপাট’ সিনেমায় আমার চরিত্রটির নাম দুরু। সে একজন ছোট মাদক ব্যবসায়ী। দুরুর স্বামী হেরোইনের ব্যবসা করতো। সে বিডির ইনফর্মার হয়ে কাজ করেছিল কিছুদিন। শাটিকাপে যেভাবে বাবুকে আটকে ফেলা হয়েছিল, বাবু নিরপরাধ হওয়ার সত্ত্বেও যেভাবে তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল একইভাবে একটা মার্ডার কেসে দুরুর স্বামী ফেঁসে যায়। তার জেল হয়। দুরু এক দারুণ লড়াইয়ের ভিতর পড়ে যায়। দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে চলতে থাকে তার জীবন যুদ্ধ। দুরু রাজশাহী শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। না বুঝে হেরোইন আসক্ত ফেরদৌসের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এরপর থেকে স্বামীর সঙ্গে পঞ্চবটি এলাকায় বসবাস শুরু করে। দুরুর আর বাবার বাড়ি ফেরা হয় না। বিয়ের দশ বছর পর কেন ও কিভাবে দুরুকে বাবার বাড়ি ফিরে যেতে হলো, সেই গল্প নিয়েই ‘সিনপাট’।

‘সিনপাট’ এর জন্য নিজেকে তৈরি করলেন কীভাবে

শাটিকাপে দুরুর এক মিনিট ৫২ সেকেন্ডের একটা দৃশ্য ছিল। সেই দুরুকে সিনেমায় বড় পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে। শাটিকাপের দুই মিনিটের চরিত্রটিকে সিনপাটে দুই ঘণ্টা টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুরু যেভাবে কথা বলে তা রপ্ত করা সহজ ছিল না মোটেও। সিনপাটের জন্য আমার চুল কাটতে হয়েছে। প্রচুর ফিল্ড ওয়ার্ক করেছি। সেই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশেছি। তাদের জীবনকে ধারণ করেছি। যারা পঞ্চবটিতে বসবাস করে তাদের কথাবার্তা চলাফেরা রপ্ত করেছি। পুরো সিনেমায় রাজশাহীর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ভাষাটা রপ্ত করাও ছিল বেশ কঠিন কাজ।

শুটিং হয়েছিল কোথায়

শুটিং শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের বিশ্বকাপের ফাইনাল ধরে আমাদের আগানোর কথা। একটা গানের কিছু দৃশ্য আছে বিশ্বকাপ ঘিরে। তারপর মূল শুটিং শুরু হয়েছে অন্যান্য জেলায় রেকি করার পরে। শুটিংয়ে আমার আবির্ভাব হয়েছে ২০২৪-এর জানুয়ারির ৮ তারিখের দিকে। এবার ৫৭ দিন শুটিং করেছি। শাটিকাপ ৬৩ দিনে শুটিং হয়েছিল। রাজশাহী বাদে পাবনা, নগরবাড়ি, দৌলতদিয়ায় শুটিং হয়েছে।

শুটিংয়ের কিছু অভিজ্ঞতা…

পরিচালক তাওকীর ভাই কঠোর পরিশ্রমী। কাজ বুঝে নিতে পারেন তিনি। সেইদিন ফ্লাইওভারে আমরা শুটিং করছিলাম। আগুন জ্বালানো হয়েছিল। ঐদিন এত বেশি শীত ছিল ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছিলাম আমরা। এর আগেও টানা ৪৮ ঘণ্টা শুটিং করেছিলাম। আমরা কেউ প্রফেশনাল না, বিশেষ করে আমাদের মূল চরিত্র সোহেল শেখ। তিনি কখনো ক্যামেরার সামনে কাজ করেননি। তার সঙ্গে অনেকগুলো দৃশ্য ছিল আমার। সেগুলো বের করে আনতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে পরিচালককে। একজনের ভালো অভিনয় দিয়ে একটা সিনেমা হয় না। সবাইকে ভালো হতে হয়। নির্মাতা তার দক্ষতা দিয়ে সবার থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছেন। মনে আছে ২২/২৩টা টেক নেওয়ার পরেও একটা দৃশ্য পারফেক্ট হচ্ছিল না। তাওকীর ভাই পুরো সিন তাৎক্ষণিকভাবে বদলে দিয়েছিলেন এবং তার মনের মতো করে কাজটি করিয়ে নিয়েছিলেন।

অন্য একটা চরিত্রে মিশে যেতে কী করতে হয় অভিনয়শিল্পীকে

আমার ব্যক্তিগত জীবনে অনেক রকমের ক্রাইসিস আছে। মা দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ। এসবের মধ্যে ক্রিয়েটিভ কাজ করা আসলেই খুব কঠিন। আমি ৭/৮ মাস দুরুর মতো হাঁটতাম, আমার ভেতর থেকে সুমুকে সরিয়ে দুরুকে ইন্সটল করতাম। কস্টিউম পরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতাম। আমি বিশ্বাস করতাম আমি দুরু। অনেকগুলো মাস দুরুর মধ্যে ছিলাম। বাস্তবের আমি ও দুরুর মধ্যে ছিটেফোঁটা মিলও নেই। দূরু রেগে আছে আবার ভয়েও আছে, এমন একটা চরিত্র ফুটিয়ে তোলা বেশ কঠিনই ছিল।

সিনেমাটি কী কারণে দর্শক দেখবে

আমি ব্যক্তি হিসেবে যদি মত দেই তাহলে বলবো এটার একটা বড় ইম্প্যাক্ট আছে। আমরা যে পলিটিক্যাল প্রেক্ষাপটে আছি, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে সিনপাট হলো একটা পলিটিক্যাল মুভি। কালচার থেকে শুরু করে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে এতে। কিছু মানুষের অন্ধকার জগতে নেমে পড়া, রাঘব বোয়ালদের শাস্তি না দিয়ে চুনোপুটিদের শাস্তি দেওয়ার মতো অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে এ সিনেমায়। শাটিকাপেও দেখানো হয়েছে রাঘব বোয়ালদের সাথে প্রশাসনের আঁতাত। শুধু ছোট মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে সমাজ থেকে মাদক দূর করা সম্ভব না। রাঘব বোয়ালদের কাছেও প্রশাসনকে পৌঁছাতে হবে। আমরা উন্নয়নের চাকচিক্য দেখছি, সমাজের অন্ধকার দিকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সেই অন্ধকার দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সিনপাটে। উন্নয়নের চাকচিক্যের সুবিধা যারা ভোগ করে তারা সমাজের খুব ছোট একটা অংশ। জনগণের মধ্যে বড় একটা অংশ এই সুবিধা পায় না, তাদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। এমনই রাজশাহীর নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। আমরা যারা এই সিনেমায় কাজ করেছি তাদের প্রত্যেকেরই সিনেমাটি নিয়ে অনেক গল্প আছে। সবার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর।

ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি দেওয়া হলো কেন

সিনেমার কনটেন্ট যেমন তাতে সেন্সর বোর্ড হয়তো পাস করতো না। চলচ্চিত্র সেন্সর ছাড়পত্র না পেলে সিনেমা হলে দেখানো যায় না। কিন্তু সিনেমাটি মানুষকে দেখানো প্রয়োজন। কারণ সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ যাদের কথা এই সিনেমায় বলা হয়েছে। এটাকে কোনো না কোনো প্ল্যাটফর্মে সামনে আনতে হবে। এটাতে মাদক আছে, গালাগাল আছে, সমাজের কথা আছে, কিন্তু অহেতুক যৌনতার সুড়সুড়ি নাই। আমরা দেখেছি ‘শনিবার বিকেল’ এর মতো সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে রেখেছে। যে চলচ্চিত্রগুলো সমাজের ক্ষত তুলে ধরে সেগুলো সহজভাবে মুক্তির কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নাই। যারা নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে তাদের জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়া কোনো অপশন নাই। অনেক মানুষ যারা সিনেমা হল ছাড়া সিনেমা দেখেন না আমরা এই গল্পটা তাদের কাছেও পৌঁছাতে চাই। যারা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন না তাদেরও দেখাতে চাই। সাধারণ মানুষেরে গল্প আমরা দেখাতে চাই উচ্চশ্রেণির মানুষদেরও।

কোন পথে যাচ্ছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতি

গত ৫০ বছরের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখবো সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নাই। যদিও মৌলিক চাহিদার মধ্যে ষষ্ঠ চাহিদা হিসেবে বিনোদনকে যোগ করা হয়েছে। সুস্থ বিনোদন না থাকায় মাদকের ব্যবসা বাড়ছে, ধর্ষণ বাড়ছে। আমরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।

সিনেমাটি নিয়ে কেমন সাড়া পেয়েছেন

ভালো রিভিউ পেয়েছি। ৮৫% রিভিউ পজেটিভ। কেউ বলেন এই সিনেমায় কোনো গল্প নাই। সিনেমাটিতে বাস্তব একটা গল্প আছে।

সবশেষে কী বলতে চান

এখনো যারা সিনেমাটি দেখেননি তারা চরকি সাবস্ক্রাইব করে সিনেমাটি উপভোগ করতে পারেন। সবাইকে সিনেমাটি দেখার আমন্ত্রণ রইল।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আলাপচারিতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × four =