বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ: ক্রিকেট মক্কায় রোদেলা দুপুরে দক্ষিণ আফ্রিকা পেলো অধরা শিরোপার সন্ধান 

অনেক সমীকরণ পাল্টে দিয়ে ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে চোকার খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকা গতকাল শনিবার ফেভারিট অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে জয় করলো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা। কেন উইলিয়ামসন, পাট কামিন্সের পর টেম্বা বাভুমার হাতে শোভা পেলো শিরোপা। ঐতিহাসিক এই জয়ের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে ঢাকায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর বিশ্ব আসরে প্রথম ট্রফি জয় করলো প্রোটিয়ান্সরা। অথচ এবারের ফাইনালে প্রথম দুইদিন শেষে ২৮ উইকেট পতন ঘটার পর ২১৮ রানে এগিয়ে থাকা সুস্পষ্ট ফেভারিট ছিল অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় দিন সকালে শেষ উইকেট জুটির দৃঢ়তায় ২৮২ রানের দুরূহ টার্গেট ছুড়ে দিয়েছিলো ক্যাঙ্গারু বাহিনী।

২৮২ রানের টার্গেটে তৃতীয় দিনের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ২ উইকেটে ২১৩ রান তুলে ফেলেছিল, তখনই একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে এই ম্যাচে ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। সেটাই চতুর্থ দিনের প্রথম সেশনে আনুষ্ঠানিক রূপ পেল। অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি নিজেদের করে নিলো প্রোটিয়ারা।

এই ঐতিহাসিক জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার এইডেন মারক্রাম ও টেম্বা বাভুমা। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনিং জুটি ভাঙে মাত্র ৯ রানে, আর ৭০ রানে পড়ে দ্বিতীয় উইকেট। তখন ক্রিজে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন এই দুই ব্যাটার। ১৪৭ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের পথ দেখান তারা।

বিশেষ করে, হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি নিয়েও বাভুমার ৬৫ রানের সাহসী ইনিংসটি ছিল অনন্য। চতুর্থ দিনের শুরুতে কামিন্সের বলে বাভুমা আউট হলেও অপরপ্রান্তে মারক্রাম খেলেন একটি দারুণ দায়িত্বশীল ইনিংস। আগের দিনের শত রানের ইনিংসকে নিয়ে যান অপরাজিত রানে। ত্রিস্তান স্টাবস দ্রুত ফিরলেও বেডিংহামকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে নেন মারক্রাম। ১৩৬ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে তার আউট হওয়ার সময় দক্ষিণ আফ্রিকা জয় থেকে ৬ রান দূরত্বে। ভেরেইনাকে নিয়ে বাকি কাজ সারেন বেডিংহাম।

১৯৮৮ থেকে ২০২৫ ব্যাবধান ৯৭২২ দিনের। এর মাঝে শিরোপার স্বপ্ন কয়েক বার উঁকি ঝুঁকি দিলেও তীরে এসে তরী ডুবেছে দক্ষিণ আফ্রিকার। জ্যাক কালিস, এবি ডিভিলিয়ার্স, অ্যালেন ডোনাল্ড, শন পলকের মত বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেট প্রতিভা যা পারেনি তাই করে ক্রিকেট বিশ্বকে বিস্মিত করলো টেম্বা বাভুমা অনুপ্রাণিত এইডেন মার্কাম, কাগিসো রাবাদা বাহিনী। ২৮২ রানের টার্গেট তাড়া করে টেস্ট তথা শিরোপা জয় দক্ষিণ আফ্রিকার ৫ম সেরা সফল টার্গেট তাড়া করা। ৪টিই সফল অস্ট্রেলিযার বিরুদ্ধে। অথচ অস্ট্রেলিযার প্রথম ইনিংসে করা ২১২ রানের জবাবে ১৩৮ রানে গুটিয়ে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা পাশার দান উল্টে দিবে কেউ ভাবেনি। সাবাস অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। ওর নেতৃত্বে ১০ টেস্টের ৯ টি জয় একটি ড্র। ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র ইংরেজ অধিনায়ক পার্সি চ্যাপম্যান এর আগে ৯ টেস্ট জয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

খেলায় ফিরে আসি। মেঘে ঢাকা ছিল লন্ডনের আকাশ যখন ১১ জুন শুরু হলো লর্ডস টেস্ট। টস জয়ী টেম্বা বাভুমা অস্ট্রেলিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ব্যাটিং করার।  উইকেটে হরাইজন্টাল মুভমেন্ট ছিল বাড়ন্ত। নতুন বলে দুর্দান্ত বোলিং করে রাবাদা, হ্যানসেন কোনঠাসা করে ফেলেছিলো কাঙ্গারুদের। স্টিভ স্মিথের বীরোচিত (৬৬) আর টেস্টে নবাগত বিউ ওয়েবস্টার (৭২) দৃঢ়তায় মুখরক্ষার ২১২ করেছিল অস্ট্রেলিয়া।  কিন্তু জবাবে ব্যাটিং করতে এসে পাট কামিন্স (৬/২৮) আর মিচেল স্টার্কের (২/৪১) তোপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৩৮ রানে গুটিয়ে গেলে অনেকেই বেভেছিলো আবারো শিরোপা জিততে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু রাবাদা, লুঙ্গি দুরন্ত বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে ৭৩/৭ চেপে ধরলো। দ্বিতীয় দিন শেষে অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেট হাতে নিয়ে এগিয়ে ছিল ২১৮ রানে। তৃতীয় দিন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বেরিয়ে আশায় প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলো। যদিও অস্ট্রেলিয়ার স্টার্ক – হেজেলউড শেষ উইকেট জুটি অস্ট্রেলিয়াকে ২৮১ রানের লিড এনে দিয়েছিলো।

শেষ ইনিংসে পাল্টে যাওয়া কৃত কল্প প্রোটিয়ারা কোমর কোষে লড়াই করলো। এইডেন মারকরাম উপহার দিলো সাম্প্রতিক টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ জয়ী ইনিংস ১৩৬. সঙ্গী সাহসী অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা।  হ্যাম স্ট্রিং ইনজুরি নিয়েও উপহার দিলো ৬৬ রানের কার্যকরী ইনিংস। ওদের ১৪৭ রানের তৃতীয় উইকেট জুটি রচনা করলো রূপকথার কাব্য। বিশ্ব স্টেস্ট ক্রিকেট শিরোপা।

একটি দল প্রথম দুই দিন সুস্পষ্ট ব্যাবধানে পিছিয়ে থেকেও নাটকীয় ভাবে জয়ী হয়ে আবারো প্রমান করলো গৌরবোজ্জ্বল অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। একজন অস্ট্রেলিয়ন হয়েও দক্ষিণ আফ্রিকাকে সশ্রদ্ধ কুর্নিশ ঐতিহাসিক এই জয়ে। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে এই ম্যাচটি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 + 4 =