টি ডব্লিউ সৈনিক
আমি আজকে বিশ্ব সংগীত দিবস উপলক্ষ্যে কিছু লিখছি যার জন্য, যার অনুপ্রেরণায়…তিনি হলেন আফরোজা আক্তার পারভীন আপা। জানিনা এত বড় ধৃষ্টতা দেখানো আমার উচিত হলো কি না। তবে যেহেতু আমি গানের মানুষ, গান ভালোবাসি গান গাইতে ইচ্ছে হয়…গান শুনি তাই একটু লোভও হলো, লোভ সামলে রাখতে পারলাম না।
সংগীতের জয় হোক…। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে শুরু করি…। সেদিন কথার ছলে, আড্ডায় একজন আরেকজনকে বলছিল…তুই ওই গানটি দেখেছিস…গুন গুন করে গাইলো এবং বললো দারুন না…? আমি তাকে প্রশ্ন করলাম কোন গানটি? ওই যে মানালিতে শুটিং হয়েছে গানটি আপনি দেখেননি? শেষে আমাকে বোঝানোর জন্য দুজন মডেলের কথাও বললেন, মানে যারা ওই গানটিতে গানের মডেল রোল প্লে করেছেন, অভিনয় করেছেন। তো আমি বললাম যে গানটি কার গাওয়া? মূল শিল্পী কে? মূল শিল্পীর নাম কেউই বলতে পারলেন না, তার নামও জানেন না। ওই গানটি যিনি কাভার করেছেন তার নাম তারা বলতে পারলেন। আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে ভাবলাম বিষয়টা কি হলো, কেন তারা মূল শিল্পীর নাম বলতে পারলেন না, কারণ কি?
আসলে গান এখন দেখার ও শোনার বিষয় হয়ে গেছে। এটা অন্যায়ের কিছু নয়, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, এটাই সঠিক বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তারপরেও আমার মনে প্রশ্ন জাগে যারা কাভার সং করছেন তারা তো প্রায় সকলেই ভালো গাইতে জানেন, গান করেন…। তো কাভার করার পাশাপাশি নিজেদের কিছু মৌলিক গানও করা উচিত বলে আমি মনে করি, এবং বিশ্বাস করি। আসলে নিজের মৌলিক গান থাকলে যে আত্মতৃপ্তি হয় তা একজন শিল্পীর জন্য অনেক পাওয়া…। এতে তার সেই গানটি অনেকদিন বেঁচে থাকে।
আমি নিজেকে গানের শিল্পী বলতে একটু লজ্জা বোধ করি। কারণ কারো সঙ্গে যখনই দেখা হয়, গানের বিষয়ে আলাপ হয় অথবা কারো সঙ্গে যখনই পরিচয় হয়, তখুনি একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। সকলেই জানতে চায় যে, আপনার গান নাই কেন? নতুন গান কবে আসবে? মিউজিক ভিডিও নাই কেন… ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আমি এই সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে একটু পিছিয়ে আছি। কারণ আমার ইচ্ছে আছে কিন্তু সাধ্য নেই এবং যত পরিমাণ টাকা খরচ করে একটা গানের ভিডিওচিত্র নির্মাণ করা হয়; আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়…আবার অনেক কম খরচেও যা সম্ভব…কিন্তু কোথায় যেন আমি আটকে যাই। আমার হয় না।
সংগীত/সুরের কোন সীমানা নেই…। সংগীত হলো এক ধরনের টনিক যা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। আমার কাছে সংগীত টনিকের মতো এই কারণেই যেমন অনেক আনন্দে আমি গান গাইতে পছন্দ করি, শুনতে পছন্দ করি। অনেক কষ্ট পেলেও গানই আমার সেই কষ্টের সঙ্গী হয় তেমনি লংড্রাইভে, অবসর সময়ে, প্রার্থনায়, ঋতুতে, বৃষ্টি; ঝড় বাদলের দিনে গানই আনন্দের খোরাক।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গান, মানসিক অবস্থা, সময়, প্রকৃতির মেজাজের উপরেও নির্ভর করে। একটি গান ভালো গান তখনিই হয় যখন সেই গানের কথা, সুর ও গায়কি ভালো হয় এবং তা অনেকদিন বেঁচে থাকে, শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে থাকে।
ঠিক এর বিপরীত হয়ে থাকে…তেমনিভাবেই কিছু কিছু গান বেশি দিন স্থায়ী হয় না, মানুষ বেশিদিন মনেও রাখতে পারে না…ঠিক সময়ের বিষ ফোঁড়ার মতো…
আবহমান কাল থেকেই বাংলাদেশে সংগীতের চর্চা চলে এসেছে। বলা হয়ে থাকে, ধানের দেশ, গানের দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে প্রকৃতির মাঝে সুর আর ছন্দ, মানুষের কণ্ঠেও পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া। কৃষাণ কৃষাণীর কণ্ঠে গান, মেয়েদের কণ্ঠে গীত আর বাউলদের একতারা তো আছেই।
আমরা বাঙালিরা সবাই গান ভালোবাসি। ধর্মে ও কর্মে এবং আনন্দে ও বেদনায় এই ছয় ঋতুর দেশের গান একটা বড় ধরনের আশ্রয়। সুরের সাথে যোগ দিয়ে মানুষ হালকা হতে চায়। সমবেত সুরে মাঝি-মাল্লারা সারি গান গায়। নৌকা বাইচ, ছাদ পেটানোর গান ও ভারী জিনিস টানতে-ঠেলতে শক্তি যোগানোর বড় প্রয়োজন। দাঁড় টানতে ভাটির টানে মাঝি ভাটিয়ালি গায়। বর্ষায় বড় নৌকায় আসর জমিয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরে ঘাটু গায়েনরা। উওরবঙ্গে গরু-মোষ যখন নিজের তালে গাড়ি টানে তখন গাড়োয়ান-মৈষাল ভাওয়াইয়া ধরে। সাঁওতাল কিষাণীরা ঝুমুর গানের মতো আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় কোন সুর…আহা মন ভরে যায়। আমরা কত সমৃদ্ধ।
লোকসুর তো নানাভাবে বদলে গেছে…তাতেও আমরা মাথা উঁচু করে গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের নিজস্ব সংগীতের সম্ভার অনেক সমৃদ্ধ। এদেশের মরমী গান, ফকির চাঁদ, লালন শাহ প্রমুখ বাউল সুর ও বাণী রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবান্বিত করেছে…নাথগীত, ময়নামতীর গান, কীর্তন, শ্যামা সংগীত, ভজন, খেয়াল, হামদ-নাত ও গজল, কতো সুদ্ধ ও সুমধুর…যদিও ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমড়ি, টপ্পার চেয়ে আজ অনেকের কাছে পাশ্চাত্যের পপ এর আকর্ষণই আজ বেশি।
আসলে ছন্দ, সংগীত, সুর…অনেক শক্তিশালী। আমাদের ভাষা, আত্মমর্যাদা, ও দেশ রক্ষায় গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানের অবদানের কথা আমরা সকলেই জানি। আমাদের বেঁচে থাকতে, সবাইকে ভালো রাখতে, ভালবাসতে…ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সংগীতের প্রয়োজন সবখানে, সবসময়ে। আর এভাবেই সংগীত বেঁচে আছে এবং থাকবে। বিশ্ব সংগীত দিবসে সকলের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
এবার আমি আমার কথা বলি…সংগীত আমার জীবনে জড়িয়ে আছে সেই জন্মলগ্ন থেকেই। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে সংগীতের চর্চা হতো। যা আমি দেখে এসেছি এবং নিজেই কখন যেন সংগীতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি, সংগীতকে ভালোবেসে ফেলেছি। বাড়িতে সকলের সঙ্গে সংগীতের চর্চা করেছি। আমাদের বাড়ির সব ভাই বোন ছায়ানটে সংগীত শিখেছি। আমিও ছায়ানটে লোকসংগীতের উপর তালিম নিয়েছি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। সংগীত প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছি, এবং পুরস্কৃত হয়েছি। পরবর্তীতে আমার একক দুটি অ্যালবাম ও চারটি মিক্সড অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার মৌলিক গানের সংখ্যা ৩৭টি।
আমি অনেক ভাগ্যবান যে আমার দুই তিনটি মৌলিক গান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। এরই মধ্যে আরো চারটি গানের কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে, রিলিজের অপেক্ষায় আছে। আমি চেষ্টা করি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার মৌলিক গানগুলো গাইতে। তবে প্রয়োজনে জনপ্রিয় অন্যান্য শিল্পীর গান করতে হয় এবং তা করেও থাকি।
তবে সবচেয়ে সুখকর বিষয় ও আনন্দের মুহূর্ত হলো…যখন আমার কোনো গান কোন স্থানে বাজতে শুনি অথবা কাউকে গাইতে দেখি। একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে এই মুহূর্তগুলো সত্যি আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। আরো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখি, যখন আমার কোনো গান কোনো শিল্পী কাভার করেছেন অথবা কোনো অনুষ্ঠানে গাইছেন।
একজন সংগীতশিল্পী সারা জীবন চেষ্টা করে যায় তার গানগুলো যেন জনপ্রিয়তা পায় এবং শ্রোতাদের মাঝে তা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে, শ্রোতারা তার গান মনে রাখেন। সেদিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান এবং শ্রোতাদের আমার অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানাই। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা