বিশ্ব সংগীত দিবস যেভাবে এলো

রঙবেরঙ ডেস্ক

যারা সংগীতে বুঁদ হয়ে থাকেন তাদের কাছে গান শোনার জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন নেই। ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন সংগীতপ্রেমীরা গান শুনে থাকেন। ২১ জুন বিশ্ব সংগীত দিবস হিসেবে পালিত হয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়। বহু বছর ধরেই ২১ জুন ঐতিহ্যবাহী মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করতো ফ্রান্স। ১৯৮২ সালে এসে এ ফেস্টিভ্যাল ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে’ তে রূপ নেয়। ‘গান হতে হবে মুক্ত; সংশয়হীন’, এই স্লোগানকে সামনে রেখেই বিশ্বের ১১০টি দেশ যোগ দেয় এই আন্দোলনে। ১৯ বছরের পথপরিক্রমায় আন্তর্জাতিক মাত্রা পায় বিশ্ব সংগীত দিবস। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে এবং ফরাসি দূতাবাসের সহায়তায় জুনের ২১ তারিখে পালন করা হয় ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে। বিশ্ব সংগীত দিবস সম্পর্কে জেনে আসা যাক।

১৯৮২ সালে ফ্রান্সে ‘ফেত দ্য লা মিউজিক‘ বা ‘মেক মিউজিক ডে’ নামে একটি দিনে সংগীত উৎসব হতো। ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী জ্যাক ল্যাং এবং সর্বপ্রথম বিশ্ব সংগীত দিবস পালনের প্রস্তাব করেন ১৯৮২ সালে। ১৯৮২ সালের ২১ জুন ফ্রান্সে প্রথম বিশ্ব সংগীত দিবস পালিত হয়। অনুষ্ঠানটি একটি দুর্দান্ত সাফল্যের মুখ দেখে, সারা দেশের হাজার হাজার সংগীতশিল্পী এই ইভেন্টে অংশ নিয়ে পুরো বিশ্বকে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। বলাই বাহুল্য সংগীত নিয়ে জ্যাক ল্যাং-এর মতো করে ফ্রান্সে খুব বেশি মানুষ ভাবেননি। তিনি ফ্রান্সের প্রথাগত গানের ধারাকে ভাঙতে মরিস ফ্লুরেটকে নিয়োগ দেন। মরিস ফ্লুরেট একজন ফরাসি সুরকার। তিনি ১৯৮২ সালে এক পরিসংখ্যান চালান। এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে সংগীত নিয়ে কাজ করা প্রচুর মানুষের কথা। সে সময় ফ্রান্সে প্রতি দুইজন তরুণের মধ্যে একজন কোনো না কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। সব নিয়ম পাশে রেখে ঘোষণা দেওয়া হয় নতুন এক ধারার। যেখানে তরুণরা শুধু চিরাচরিত সংগীত শিখবেন না, শিখবেন রক-জ্যাজ-পপ, সব ধারার সংগীত। আর শেষমেশ জ্যাক ল্যাং, প্রকৌশলী ক্রিস্টিয়ান ডুপাভিলন আর মরিস ফ্লুরেটের চেষ্টায় এই উদ্যোগ সফলও হয়েছিল।

১৯৮৫ সালের ২১ জুন প্রথম গোটা ইউরোপ এবং পরে সারাবিশ্ব এই সংগীত দিবস পালন করে। এরপর থেকে দিনটি বিশ্ব সংগীত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পর্যায়ক্রমে প্রতি বছর বিশ্ব সংগীত দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রথম থেকেই আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দিবসটি পালন করে আসছে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ হচ্ছে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচার-প্রসারের আন্তর্জাতিক সংগঠন। অন্যদিকে অনেকের মতে, ১৯৭৬ সালে ফ্রান্সে মার্কিন সংগীতশিল্পী জোয়েল কোহেন ‘সামার সোলস্টাইস’ বা গ্রীষ্মকে উদযাপন করতে সারারাত গান চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতেই আসে ২১ জুনের সংগীত দিবস।

বিশ্ব সংগীত দিবস একটি বিশ্বব্যাপী উৎসবে পরিণত হয়েছে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই দিনের জনপ্রিয়তা। বিশ্ব সংগীত দিবসটি ১২০টি দেশের ১ হাজারের অধিক শহরে একই দিনে পালিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে ভারত, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, পেরু, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং জাপান। বিভিন্ন দেশে এই উৎসবের বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন ফ্রান্সে ‘লা ফেটে দে লা মিউজিক’, যুক্তরাজ্যে ‘মেক মিউজিক ডে’, ইতালিতে ‘ফেস্তা ডেলা মিউজিকা‘, পোল্যান্ডে ‘সুইটো মুজিকি’। বিশ্ব সংগীত দিবসে নানা অঞ্চলের মানুষ তাদের স্থানীয় গান শোনে এবং বাজায়। আপনি রাস্তায়, ক্যাফে বা পার্ক এবং অন্যান্য পাবলিক স্পেসে গান শুনতে পারবেন। আপনাকে এই কনসার্টের জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে না। শিল্পীরা বিনামূল্যে সংগীত পরিবেশন করে। বিশ্ব সংগীত দিবস সকল অপেশাদার-পেশাদার শিল্পী, তরুণ-বৃদ্ধ সবাইকে পারফর্ম করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও এইদিনে সারা বিশ্বের সংগীতশিল্পীরা লাইভ পারফরম্যান্স, জ্যাম সেশন এবং কনসার্টের মাধ্যমে দিনটি উদ্্যাপন করে। বিশ্ব সংগীত দিবসটি বিভিন্ন ঘরানার মানুষ উদযাপন করে থাকেন। যার মধ্যে রয়েছে জ্যাজ, রক, ক্লাসিক্যাল এবং আরও অনেককিছু।

প্রতি বছর বিশ্ব সংগীত দিবসে একটি থিম নির্ধারণ করা হয়। ২০২৩ সালের থিম ছিল ‘মিউজিক অন দ্য ইন্টারসেকশন’। ২০২২ সালের থিম ছিল ‘মিউজিক অ্যাট দ্য ইন্টারসেকশনস’। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব সংগীত দিবস ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ’ এই দিনটি পালন শুরু করে। বর্তমানে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্ব সংগীত দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদসহ সংগীতের বিভিন্ন সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বর্ণিল আয়োজনে দিবসটি পালন করে।

মানবশিশু কথা বলতে শেখার আগেই গুনগুনিয়ে সুর তুলতে শুরু করে। সংগীতের কোনো ধর্ম নেই, কোনো জাত নেই, কোনো রঙ নেই, কোনো বয়স নেই। এর স্বকীয়তা এতটাই প্রবল যে সেটা কোনো বিশেষ ভাষার কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। কোনো কাঁটাতারের বেড়া সংগীতকে বাধা দিতে পারে না। সংগীতজ্ঞ বব ডিলান কিংবা জিম মরিসনের গান যেমন এদেশের মানুষের মন ছুঁয়েছে, তেমনি আমাদের লালনের গানও পৌঁছে গেছে বিশ্বের দরবারে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শাস্ত্র ও ধর্মীয় সংগীতকে আশ্রয় করে বাংলা সংগীত আজ প্রসারিত হচ্ছে। জারি-সারি-বাউল গান, রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুল গীতি আমাদের বাংলা সংগীতকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে। আধুনিক গানের চর্চা সেই ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। সংগীতের হাত ধরে মেলবন্ধন ঘটে মনের। বিশ্ব সংগীত দিবস আসলে সংগীতের মাধ্যমে বিশ্বকে এক করে।

সংগীত নিয়ে বিখ্যাত উক্তি

*    কিছু মানুষের জীবন আছে, কিছু মানুষের গান আছে – জন গ্রিন

*    গান যদি ভালোবাসার খাদ্য হয় তবে চালিয়ে যান – উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

*    সংগীত সমস্ত প্রজ্ঞা এবং দর্শনের চেয়ে উচ্চতর এক প্রকাশ – লুডউইগ ভ্যান বিটোভেন

*    পদার্থবিজ্ঞানী না হলে আমি সম্ভবত সংগীতশিল্পী হতাম। আমি প্রায়শই সংগীত নিয়েই ভাবি। আমি আমার দিবাস্বপ্নে গানের মধ্য দিয়েই জীবনযাপন করি। আমি আমার জীবনকে সংগীত দিয়ে বিবেচনা করি – অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

*    সংগীত এতটাই শক্তিশালী যে মানুষ যখন এটি শোনে, তারা এর সাথে প্রভাবিত হতে পারে এবং তারা সাড়া দেয় – রে চার্লস

*    সংগীত নিজেই একটি গোটা দুনিয়া। এটি এমন একটি ভাষা যা আমরা সকলেই বুঝতে পারি – স্টিভ ওয়ান্ডার

*    এই মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসের একটি ছন্দ আছে, সব কিছু নাচে – মায়া অ্যাঞ্জেলু

*    সংগীত মহাবিশ্বকে প্রাণ দেয়, মনকে ডানা দেয়, কল্পনায় উড়তে দেয় এবং সবকিছুকে জীবন দেয় – প্লেটো

*    সংগীত একটি ভালো দিক হলো, যখন এটি আপনাকে আঘাত করে, আপনার আর কোনও ব্যথা অনুভব হয় না – বব মার্লে

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × five =