বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন: ‘পরিকল্পনা-বাস্তবায়নে’ যুবদল

‘বেনাপোল এক্সপ্রেসে’ ট্রেনে আগুন দেওয়ার ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে উঠে এসেছে যুবদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম এবং সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের নাম। এ দুজনের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এই নাশকতা ঘটনো হয় বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য।

গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনার তদন্তে  নেমে মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মনসুর আলমকে গ্রেপ্তারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই তথ্য মিলেছে।

মনসুরকে শনিবার ভোর রাতে চকবাজার থানার বেড়িবাঁধ চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের সময় মনসুরের কাজ থেকে নগদ ৩০ হাজার টাকা, একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও একটি বাটন মোবাইল উদ্ধার করেছে পুলিশ।

মনসুর ছাড়াও এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিএনপি নেতা মোহাম্মদ নবী উল্লাহ নবী (৬৬)  এবং যুবদলের আরও ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি লালবাগ ও ওয়ারী বিভাগ। তারা হলেন- মো. ইকবাল হোসেন স্বপন, মো. রাসেল, দেলোয়ার হাকিম বিপ্লব, মো. সালাউদ্দিন, মো. কবির ও মো. হাসান আহমেদ।

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে উপ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “ভয়াবহ নাশকতার এই পরিকল্পনা হয় ভিডিও কনফারেন্সে। আর তাতে অংশ নেয় ১০ থেকে ১২ জন।”

ডিবি কর্মকর্তা মশিউর বলেন, “মনসুরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক খন্দকার এনাম, সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন, যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ গাফফার, যুগ্ম আহবায়ক ইকবাল হোসেন বাবলু, দপ্তর সম্পাদক শাহজাহান চৌধুরীসহ দক্ষিণ যুবদলের ৮টি টিমের টিম লিডাররা ভার্চুয়াল কনফারেন্স করে।

ওই কনফারেন্সে খন্দকার এনাম হামলার বিশদ পরিকল্পনা সবার সমানে তুলে ধরতে বলেন নয়নকে। তখন নয়ন ২টি মূল বিষয় বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়।

মশিউর বলেন, “ওই কনফারেন্সে বলা হয়, জানুয়ারির ৫, ৬ তারিখ এবং ৭ জানুয়ারি দিনে এবং রাতে সুবিধাজনক সময় যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রার্থীদের অস্থায়ী নির্বাচনি ক্যাম্পে আগুন এবং কেন্দ্রের আশপাশে ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা রকমের ধ্বংসাত্মক কাজগুলো ওয়ার্ড এবং থানা যুবদলের নেতাকর্মীদেরকে দিয়ে ঘটিয়ে সেসবের ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে উপরে (দলের শীর্ষ পর্যায়) পাঠানোর কথা বলা হয়। আরও বলা হয়, ভোটরারা যাতে কেন্দ্রে না যেতে পারে সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এই টিমটিকে।

“এছাড়া বৃহত্তম ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী ট্রেনে নরসিংদীর পর থেকে সুবিধাজনক জায়গায় অগ্নিসংযোগ করার কথাও আলোচনা হয়। কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে আপ এবং ডাউন ট্রেনে সুবিধাজনক জায়গায় যাত্রীবাহী বগিতে কৌশলে আগুন লাগানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। যাতে নাশকতার ঘটনাটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে মিডিয়ার চোখে পড়ে। এবং জনগণ চূড়ান্তভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়।”

ডিবি কর্মকর্তা মশিউর সম্মেলনে বলেন, “এনাম ও নয়নের পরিকল্পনা এবং নির্দেশনায় যুবদল দক্ষিণের ২ জন টিম লিডার, নয়নের বিশ্বস্ত লালবাগের ৩ জনসহ আরো কয়েকজন সন্ত্রাসীকে দিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।”

তবে এনাম ও নয়ন এখনো পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়নি।

ভোট ঠেকাতে বিএনপির ডাকা হরতালের আগে শুক্রবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগ কাঁচাবাজারের কাছে এসে থেমে যায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি। সে সময় ট্রেনের কয়েকটি বগি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেন। সেসময় ভেতর থেকে ভেসে আসছিল যাত্রীদের আর্তনাদ। ওই ঘটনায় নিহত হয়েছেন চারজন, নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। হাসপাতালে ভর্তি আটজনের অবস্থাও শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মনসুরের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভুঁইয়ায়। স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে আলিম পরীক্ষার আর বসা হয়নি তার। কাজের সন্ধানে ২০০০ সালে মনসুর ঢাকায় এসে ফকিরাপুলের একটি ট্রাভেলিং এজেন্সিতে চাকরি নেন।

ওই সময় থেকে মনসুর নয় পল্টনে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বাড়ে। মিছিল মিটিং ছাড়াও মনসুর বিএনপির ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে’ জড়িয়ে পড়েন বলে গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য।

পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর জানান, ২০২১ সালের মার্চ এপ্রিলে গঠিত যুবদল দক্ষিণের আহবায়ক কমিটিতে মনসুর অন্যতম সদস্য হন।

গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ‘অতীত অভিজ্ঞতা এবং দলীয় আনুগত্যের’ কারণে মহানগর দক্ষিণের লালবাগ, চকবাজার এবং বংশাল এলাকার যাবতীয় ধ্বংসাত্মক কাজের সমন্বয়ক হিসেবে মনসুরকে নির্বাচিত করা হয় বলে জানান মশিউর।

“ওই সময় থেকে মনসুর তিন থানা এলাকায় ওয়ার্ড ও থানার যুবদলকে সংঘটিত করা, তাদের কার্যকলাপ মনিটরিং করা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের ছবি ও ভিডিও দলের ওপরের মহলের নেতাদের কাছে পাঠানোর কাজটি করে আসছিল। এছাড়া কর্মীদের মধ্যে কাজের দায়িত্ব বিলি বন্টনের কাজটা মনসুর করে আসছে।”

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলের নেতাকর্মীরা একত্রে বসে মিটিং করে না। তারা ইন্ডিভিজুয়ালি এবং গ্রুপভিত্তিক হোয়াটসঅ্যাপ কনফারেন্সিং করে থাকে।”

বিডিনিউজ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 1 =