সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
আসছে বর্ষাকাল। ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, এমনকি বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোও। বৃষ্টিতে জলমগ্ন ঢাকা বা চট্টগ্রামের ছবিটা দেশবাসীর চেনা। প্রতি বছর এই সময়টায় ডুবে যায় শহরগুলো।
এখন আর ভারী বৃষ্টির দরকার হয় না। সম্প্রতি আমরা দেখেছি সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়। কারওয়ান বাজারে জমে প্রায় হাঁটুসমান পানি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখিয়েছে বৃষ্টির পরে রাজধানীর মিরপুরসহ অনেক স্থানে হাঁটুসমান পানি জমেছে। একই সময়ে চট্টগ্রামেও এমনটা ঘটেছে।
অনেক বছর ধরে এই চিত্রটিই আমরা দেখছি দুটি বড় শহরে। রাজধানী ঢাকায় অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বৃষ্টির অবিরাম ধারা চলতে থাকলে পানি নিষ্কাশনের হতশ্রী চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায় সবার সামনে। মতিঝিল থেকে সচিবালয়, ভিআইপি রোড থেকে অলিগলি, ঢাকার সর্বত্র এখন জলজট তৈরি হয়। কোনো বছর বেশি হয় আর কোনো বছর কম হয় বা এখন নয়, অন্য যুগে বেশি ছিল তা নিয়ে তর্ক চলছে। তবু পরিসংখ্যান ছাড়াই বোধহয় এটা বলা চলে যে, এতো দ্রুত এবং ব্যাপক পানি জমে যাওয়া নগরবাসী সাম্প্রতিককালেই দেখছে। কী করে দিন দিন এমন ভয়ানক আকার নিচ্ছে জলাবদ্ধতা সেই ইতিহাস খোঁজার চেয়ে সমস্যা সমাধানে দৃষ্টি দেওয়াই শ্রেয়।
যারা কথায় কথায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ঠাট্টা করে এই সমস্যার সঙ্গে রাজনীতি মেশান; তাদের উদ্দেশে বলছি, ভারী বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যাওয়াটা নতুন ঘটনা নয়। ফি বছর লাগাতার বৃষ্টিতে শহরে পানি জমে। শহরের কেন্দ্রস্থলে, সচিবালয়ে বিগত জোট সরকারের আমলে পানি জমে গিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। তাই সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ খুব কম।
এ বছরও আবহাওয়াবিদরা অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছেন। তাই শঙ্কাও বাড়ছে। রাজধানীতে এমন বেশকিছু জায়গা আছে যেখানে প্রায় সারা বছরই কমবেশি পানি জমে থাকে। আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই। জল থইথই এলাকাগুলি মূল সড়ক থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জমে থাকা নোংরা পানি মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় নাগরিকদের। পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতরেও।
প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে বিশেষ করে কয়েকদিন ধরে বিরামহীন চললে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়। একেবারে ডুবে যায় রাজধানী। আর ডুবন্তই থাকছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলো থেকেও জলজটের খবর আসে প্রতি বছর। আসলে অবস্থাটা এখন এমন বর্ষার দরকার নেই। বৃষ্টির আগে মেঘ দেখলেই ভেসে যায় আমাদের শহরগুলো। অথচ এই শহরগুলোর নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা নানা সরকারের আসলে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের শহর সমূহের নিষ্কাশন ব্যবস্থা এমন বেহাল কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু উত্তর নেই। নেই কারণ শুধু মেয়রদের দোষ দিয়ে এই উত্তর পাওয়াও যাবে না।
যে কথা বলা হয়েছে বহুবার তা হলো পানি নিষ্কাশনের কাজ হয়েছে এবং বহুবারই হয়েছে। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে, সমন্বয়হীনভাবে। এলাকাভিত্তিক বিচ্ছিন্নভাবে কাজ হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো করে করেছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব পরিকল্পনায় কিছু করতে পারেনি। কারণ এসব ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা আছে, আছে আরো নানা সরকারি সংস্থা। ফলে সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় সেসব কিছুই মানুষের কাজে এলো না। শহরের নিষ্কাশন সমস্যার কোনও সমাধান তো হলোই না, বরং মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ল।
রাজধানীর চারদিকে একসময় কত খাল ছিল। ছিল বেশ কিছু বড় জলাশয়ও। আগে যখন সেভাবে এই শহরে নিকাশি-নর্দমা তৈরি হয়নি তখন প্রাকৃতিকভাবেই বর্ষার জল এই সব জলাশয়, নদী-খাল ও নিচু এলাকায় গিয়ে পড়ত। তাতে শহরে তেমন পানি জমত না। এখন একের পর এক জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়িঘর আর স্থাপনা। ফলে শহরের নিজস্ব প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। তার উপরে কৃত্রিমভাবে তৈরি নর্দমা বা হাইড্রেনগুলিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি না হওয়ায় শহরের পানি সব জমে গিয়ে তৈরি করে এই বেহাল অবস্থা।
এ শহরে মানুষের আচরণও আজ প্রশ্নের মুখে। সামাজিকমাধ্যমে সরকার বা মেয়রদের গালি দিয়ে, ট্রল করে মজা পাওয়া যায় ঠিকই; কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার হওয়া যায় না। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার যে অভ্যাস আমরা করেছি, যেভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলছি রাস্তায়; তা পৃথিবীর খুব দেশের নাগরিকরাই করে।
এসব পলিথিন আর প্লাস্টিকে আটকে যাচ্ছে ড্রেনের মুখ। বৃষ্টি হলেই ড্রেনের পানিতে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। তবু আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহারে কমতি নেই। শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে পারে, বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। সেই কাণ্ডজ্ঞান কী আছে আমাদের? বাজার বা বাড়ির জঞ্জাল রাস্তায় ফেলা আমাদের সংস্কৃতি। যে কোনো বাড়িতে খাবারের পর ময়লা ফেলা হচ্ছে নর্দমায়, বাড়ির বাইরে সদর রাস্তায়। যে নগরীর মানুষের এমন সংস্কৃতি, তারা আবার কর্তৃপক্ষকে দোষ দেয় কি করে, তারা আবার ট্রল করে কাকে নিয়ে?
আমাদের আরো কীর্তি আছে। যত আধুনিক হচ্ছি, প্রকৃতিকে ততই লুণ্ঠনের সামগ্রী বিবেচনা করছি আমরা। অরণ্য ও নদ-নদী সেই লুণ্ঠনের প্রধান শিকার। খাল, বিল দখলতো হয়েছেই, নদীও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। পানি প্রবাহের যেসব পথ ছিল সেসবের উপর যে পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই ভীতিপ্রদ। নদী ও অন্যান্য জলাশয় ভরাট করে, স্বাভাবিক গতি রোধ করে বিপুল পরিমাণে জৈব ও রাসায়নিক আবর্জনা ফেলে, অকল্পনীয় অবিবেচনায় আধুনিক নগরসভ্যতা গড়তে গিয়ে পানি প্রবাহের সব পথ বন্ধ করে এখন কেবল মাতম করছি আমরা।
বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য আগে যেসব খাল ছিল, সেগুলো ভরাট করে ঘরবাড়ি-দালান করা হয়েছে। রাস্তা হয়েছে। এগুলো খাসজমি, যা কিনা ইজারা দেওয়া, দালান তৈরি করা বা ভরাট করার কথা নয়। ওয়াসা খালের পথ ধরে নয়, রাস্তা ধরে কালভার্ট অথবা পাইপ ড্রেনেজ নির্মাণ করেছে। এসব ড্রেন সোজাসুজি পথে যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে আগের খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত করে, ঠিকমতো নকশা করে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ করতে অনেক বছর লাগবে। কিন্তু কাজটা তো শুরু করতে হবে। শহরের সার্বিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন না হলে প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার সমস্যা নিয়ে হা-হুতাশ করতে হবে।
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সিনিয়র সাংবাদিক
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন