বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কপ২৭-এর লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে

আফরোজা আখতার পারভীন: বর্তমান পরিস্থিতিতে কপ২৭-এর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো ধরে রাখা কঠিন হবে। রাজনৈতিক আস্থা ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় এর আগের কপে যে গতি অর্জিত হয়েছে তা বিঘ্নিত হবে। উন্নত দেশগুলোর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। যে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রিুতি ছিল তা যুদ্ধে ও কোভিড পুনর্বাসনে যাচ্ছে। এটি কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ, যদিও তারা তা স্বীকার করছে না। যদিও জি৭ এরই মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে দু’বার আলোচনায় বসেছে। যদিও তারা বলছে না যে, দূষণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা তারা কমাবে। তবে বোঝা যায়, অর্থ দেওয়ার ও দূষণ কমানোর যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিল, তা তারা রক্ষা করতে পারবে না।
বিসিপিসিএল-ইপি ক্লাইমেট টকস-এর অতিথি পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, এবার কপ২৭-এ ৩/৪টা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ফাইন্যান্স, লস অ্যান্ড ড্যামেজ, বৈশ্বিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নেট জিরো, এডাপটেশন ইত্যাদি। এবার এডাপটেশন নিয়ে নেট জিরো গোল সেট করা হবে। গত কপে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এর সঙ্গে আঞ্চলিক লক্ষ্যমাত্রার একটা সংযোগ তৈরি করা হবে। আইপিসিসি’র রিপোর্ট অনুযায়ী ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৪৫ শতাংশ দূষণ কমাতে হবে ২০৩০-এর মধ্যে। দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ হবে ২০২৫ সালে। এর পরে তা আর বাড়ানো যাবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে দূষণ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। তাহলেই বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। কপ ২৭-এ এর জন্য মিটিগেশন ওয়ার্ক প্ল্যান তৈরি করা হবে। বৃহৎ দূষণকারীদের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক দূষণ লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হবে।
তার মতে, ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রাপ্তির বিষয়টি বিবেচনা করে কতোটুকু অগ্রগতি হলো তা বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়াও বড় বিতর্ক হবে লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য ফান্ড গঠন নিয়ে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)-এর আওতায় তা হবে, না অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থায়ন হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সকল উন্নয়নশীল দেশের দাবি হলো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে আলাদা এজেন্ডা নিতে হবে। প্রাথমিক এজেন্ডায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন এবার একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। তবে ৭০ বিলিয়ন ডলার জিসিএফ তহবিলে জমা হয়েছে, বাকি ৩০ বিলিয়ন ডলার ২০২২ সালের মধ্যে সংগ্রহ করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী। কপ২৭-এ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন। কপ২৭-এর আগেই ১০০ বিলিয়ন তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অজর্নে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কপ২৬-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কয়লা থেকে ফেজআউট এবং ফসিল ফুয়েলে সাবসিডি কমেনি। বর্তমান জ্বালানি সঙ্কটে ফসিল ফুয়েল বাদ দিয়ে পরিবেশ সহনীয় জ্বালানি দিয়ে বিপুল চাহিদা মেটাতে পারবে না। ফলে গত কপের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে না।
জিয়াউল হকের মতে, বাস্তবতা বলছে যে, নেট জিরো অর্জন পিছিয়ে যাবে। আমাদের লক্ষ্য হলো ১.৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা ধরে রাখার লক্ষ্য অর্জন। তাপমাত্রা যদি ১.৫ বা ২ ডিগ্রি অতিক্রম করে যায় তাহলে বিশ্বের অবস্থা হবে খুব বিপদজনক। অর্থাৎ পিকিং পয়েন্ট অতিক্রম করে যাবে। এজন্য লক্ষ্য হলো কোনোভাবেই যেন ১.৫ ডিগ্রির উপরে যাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ সবার সহায়তা প্রয়োজন। নেট জিরো অর্জনের জন্য আগামী কয়েক বছর যে ঘাটতি থাকবে, তাতে ২০৫০ সালে নেট জিরো অর্জন করা যাবে না।
ওয়ারশ প্রটোকলের আওতায় এতদিন লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়ে টেকনিক্যাল আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়েছে। আলোচনা যথেষ্ট হয়েছে, এখন অর্থ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হতে হবে। এর জন্য তহবিল গঠন করতে হবে। যাতে করে তৎক্ষণাৎ সহায়তা দেওয়া যায়। কোথাও কোনো বিপর্যয় হলে মোকাবেলা করা যায়। উন্নত দেশগুলো সংহতি দেখায়, কিন্তু যখন ক্ষতিপূরণের কথা ওঠে তখন তারা পিছিয়ে থাকে। এখন ক্ষতিপূরণ চাওয়া হচ্ছে না, যেন গ্লোবাল ফান্ড গঠন হয়, সে বিষয়ে কথা হচ্ছে। যাতে করে কোনো বিপর্যয়ের পরপরই এই ফান্ড থেকে সহায়তা করা যায়। কপ২৭-এ এটাকে প্রভিশনাল এজেন্ডায় আনা হয়েছে, আশা করা যায় তা গৃহীত হবে। আমরা চাই সাউথ এশিয়াতে যেন একটা হাব করা হয়। ‘নিউ কালেকটিভ গোল অন ফাইন্যান্স’ নামে নতুন প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে যা ২০২৫ সাল থেকে কার্যকর হবে। আলোচনা চলছে, ২০২৩ সাল থেকে কি পরিমাণ অর্থ লাগবে অ্যাডাপটেশন, মিটিগেশন, লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য। তা কোনোভাবেই ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে হবে না। আশা করা যাচ্ছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে আলোচনা শুরু হবে। এটা আলোচনার পর্যায়ে আছে। কেউ কেউ বলছেন ২০০ বিলিয়ন লাগবে। কপ২৭-এ সিদ্ধান্ত হবে না, ২০২৩-এর কপ২৮-এ হতে পারে।
তিনি জানান, ২০১৮ সালের প্যারিস রুলবুকে বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত রয়েছে। গত কপে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এনডিসি বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও কথা হবে। কি প্রক্রিয়ায় হবে তাও দেখা হবে। উন্নয়নশীল দেশের বড় সমস্যা হলো এর বড় অংশ ধরা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে। মানে আন্তর্জাতিক সহায়তা পেলে এলডিসি বাস্তবায়ন করা হবে। জিসিএফ ফান্ডের প্রায় ৬০ শতাংশ যায় মিটিগেশনে। ৪০ শতাংশ যায় এডাপটেশনে। জিসিএফ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এডিবি এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও সহায়তা আশা করা হচ্ছে। যা সহায়তা নয়, কম সুদে ঋণ।
বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে তিনি বলেন, ডকুমেন্টশনে আমাদের উন্নতি করতে হবে। গত ১০ বছরে কী করেছি, এনডিসিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে যখন এনডিসি অগ্রগতি রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে, তখন যেন সার্বিক ভাবে তা তুলে আনতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর যদি পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়, তাহলে ভালো হয়। আমরা অনেক মিটিগেশনের কাজ করেছি, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে জানাতে হবে।
এনডিসিতে নতুন একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কী কী করা হবে তা বলা হয়েছে। ন্যাশনাল একশন প্ল্যান চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। অক্টোবর মাসেই তা শেষ হবে। সেখান থেকে ১০-১৫টা পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প শেষ করতে হবে। এখানে কিছুটা দক্ষতার অভাব আছে। তবে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে। যথাযথ প্রকল্প তৈরি করে জিসিএফে দাখিল করতে পারলে সহায়তা পাওয়া যাবে।
তিনি আরও জানান, কপ২৭-এ এবার বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নে ২১টা সাইড ইভেন্টের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা যায়। অন্য দেশগুলো যেন অংশ নেয় সে চেষ্টাও করা হচ্ছে। মিটিগেশন প্রোগ্রামে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে কার্বন ট্রেডিং নিয়ে বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হবে। সেখানে যদি ঠিকভাবে নিজেদের উপস্থাপন করা যায়, তাহলে সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে কয়লাভিত্তিক কোনো প্রকল্পে এখন অর্থ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। আমরা যদিও বলছি, আলট্রা ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করে দূষণ কমাচ্ছি, কিন্তু এক্ষেত্রে সহায়তা পাওয়া যাবে না। তবে পরামাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সহায়তার ব্যাপারটি আলোচনার পর্যায়ে আছে। এটাকে কার্বন ফ্রি হিসেবে বিবেচনা করা হবে কি না।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 − 1 =