ভার্সেটাইল অভিনেত্রী আফসানা মিমি

শবনম শিউলি

দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফসানা মিমি। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সহজ-সরল মেয়ে বকুল কিংবা ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের বিলেত ফেরত ডাক্তার কিংবা ‘হাউস ওয়াইফ’ নাটকে একেবারে ভিন্নধর্মী একাধিক চরিত্র। প্রসাধনী বিজ্ঞাপনের লাস্যময়ী স্নিগ্ধ মডেল। ‘বন্ধন’, ‘কাছের মানুষ’, ‘ডলস হাউস’, ‘সাড়ে তিন তলা’, ‘সাতটি তারার তিমির’সহ সেই সময়ের জনপ্রিয় কিছু নাটকের পরিচালক। সর্বশেষ ‘পাপ পুণ্য’ চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পারুল বানু হয়ে পর্দায় ফেরা। নব্বই দশকে টেলিভিশন নাটকের প্রিয়মুখ আফসানা মিমি। পর্দা আর মঞ্চে কাজ করেছেন অনেক। একটা সময় পর্দা থেকে আড়ালে সরে গিয়েছিলেন তিনি। আবারও ফিরেছেন অভিনয়ে। মঞ্চ, সেলুলয়েড কিংবা ওটিটি সবখানেই নিজের অভিনয় শৈলীর ছাপ রেখেছেন এই অভিনেত্রী। ‘পাপ পুণ্য’ সিনেমার জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আফসানা।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯৬৮ সালে ২০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আফসানা মিমির বাবা সৈয়দ ফজলুল করিম পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। তার মা শিরীন আফরোজ যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ১৯৮৬ সালের দিকে মায়ের হাত ধরেই থিয়েটারে কাজ করা শুরু। অভিনয়জীবন তখন থেকেই শুরু করেছিলেন আফসানা মিমি। তবে কিছুদিন পর মা তাকে সরিয়ে আনেন সেখান থেকে। কারণ প্রতিদিন সন্ধ্যায় থিয়েটারে যাওয়ার কারণে লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকে তার। এক সাক্ষাৎকারে আফসানা মিমি বলেন, তারা সবাই মায়ের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন। অর্থাৎ মা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই শেষ কথা। মায়ের আগ্রহ থেকেই থিয়েটার শুরু করা আবার মায়ের কথাতেই থিয়েটার থেকে বিরতি নেন আফসানা মিমি। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করেন নিজের ইচ্ছায় স্বাধীন জীবন। মিমি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে অভিনয় করেন। সেখানে বকুল চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি লাভ করেন আফসানা মিমি। তারপর থেকে তিনি বহু টেলিভিশন নাটক এবং কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া বেশকিছু প্রসাধনী পণ্যের বিজ্ঞাপনেও তাকে দেখা গেছে।

পর্দায় দৃপ্ত দুটি চোখ

যারা আফসানা মিমির কাজগুলো দেখেছেন তারা অবশ্যই একমত হবেন আফসানা মিমির চোখের ভাষা নিয়ে। সাবলীল অভিনয় আর তার চোখের ভাষা বারবার দর্শককে তার দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য করেছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বকুলই নয় ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে জাহিদ হাসানের বিপরীতে বিলেত ফেরত একজন মর্ডান নারীর চরিত্রে আফসানা মিমির সাবলীল অভিনয় দর্শকের নজর কেড়েছে। ১৯৯২ সালে আজিজুর রহমানের ‘দিল’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয় তার। তারপর ১৯৯৪ সালে ‘নদীর নাম মধুমতি’, ১৯৯৯ সালে ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ২০০৯ সালে ‘প্রিয়তমেষু’ ছবিতে অভিনয় করেন আফসানা মিমি। ‘মনের কথা’ নামে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেন তিনি।

পর্দার পেছনের মিমি

পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছেন মিমি। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের গল্প ‘ক্যাম্প’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের পরিচালনা করেন। নব্বই দশকে টেলিভিশনে প্রচারিত হতো কিছু ধারাবাহিক নাটক। যেগুলো সেই সময়ে দর্শকের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। তারমধ্যে অন্যতম নাটক ‘বন্ধন’। এই ধারাবাহিক নাটকটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকটিতে ক্যামেরার পেছনে নানা ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন আফসানা মিমি। এই প্রযোজনার অন্দরসজ্জা, চিত্রকল্প, কার্যনির্বাহী প্রযোজক ছিলেন মিমি। এ ছাড়া এটিএন বাংলায় সম্প্রতি শেষ হয়েছে তার পরিচালিত ‘সাতটি তারার তিমি’র নাটকটি। আফসানা মিমির প্রোডাকশন হাউসের নাম কৃষ্ণচূড়া।

নিজের কাছে আফসানা

একটি সাক্ষাৎকারে আফসানা মিমি বলেন, ‘কোনো অপূর্ণতা নেই আমার নিজের দিক থেকে। নিজেকে আরও তৈরি করতে হবে, এই ধরনের অপূর্ণতা থাকতে পারে কিন্তু অভিনয়জীবন নিয়ে কোনো অপূর্ণতা নেই। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি। নতুন জেনারেশনও আমার অভিনয় দেখার পর প্রশংসা করে। পাতালঘর কিংবা মহানগর নতুন জেনারেশন দেখে প্রশংসা করে। হূমায়ুন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেছি। সেসব নতুন জেনারেশন দেখে। কাজেই মানুষের এই ভালোবাসার কাছে অপূর্ণতা থাকবার কথা নয়।

আফসানার মঞ্চে ফেরা

৩৩ বছর আগে ‘দর্পণ’ নাটক দিয়ে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে পথচলা শুরু হয় আফসানা মিমির। ২০০২ সালের শেষের দিকে ‘খাট্টা তামাশা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ ও ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ নাটকে দেখা গেছে তাকে। মাঝে ২০ বছর মঞ্চে দেখা যায়নি অভিনেত্রীকে। দুই দশক পর তিনি ফিরছেন ৩৩ বছর আগে অভিনয় করা সেই নাটক নিয়ে। মাঝে অবশ্য প্রাচ্যনাটে কাজ করেছেন এই অভিনেত্রী। এই দলের হয়ে ‘রাজা এবং অন্যান্য’ নাটকে ২০০৭ সাল থেকে টানা চার বছর অভিনয় করেছেন। নাটকের পাশাপাশি আফসানা মিমি ‘দিল’, ‘চিত্রা নদীর পারে’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘পাপ পুণ্য’, ‘পাতালঘর’-এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ওটিটিতে ‘নিখোঁজ’ ও ‘মহানগর ২’-এ অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। বিরতির পর এসব কাজ করতে গিয়ে মঞ্চে ফেরার তাগিদ অনুভব করেন তিনি।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের অল্পবয়সী মেয়ে বকুল থেকে সর্বশেষ ‘পাপ পুণ্য’ সিনেমায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের মা পারুল বানু; সবগুলো চরিত্রেই আফসানা মিমিকে সাবলীল এক অভিনেত্রী হিসেবে দেখতে পেয়েছেন দর্শক। তার সুচারু অভিনয়, চোখের চাহনি আর মিষ্টি হাসি আজও দর্শককে তার দিকে টানে। মঞ্চে তার উপস্থিতই আজও ঠিক ততটাই মুগ্ধ করে দর্শককে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আলাপচারিতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two + 6 =