রঙবেরঙ ডেস্ক
চমৎকার সব পর্বত, উপসাগর-খাঁড়ি, সাগরসৈকত, প্রাচীন অরণ্য, মাওরি আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি – এ সবকিছুর জন্য পর্যটকদের ভারি পছন্দের জায়গা নিউ জিল্যান্ড। আর আছে বিভিন্ন সৈকত আর পাহাড়ে প্রমাণ আকৃতির সব পাথর। তবে এসবের মধ্যে আবার বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে মোয়েরাকি বোল্ডার বা মোয়েরাকি পাথর। সাউথ আইল্যান্ডের পূর্ব উপকূলের সৈকতে দেখা পাবেন বিশাল এই পাথরগুলোর।
মোয়েরাকি বোল্ডার বা পাথরগুলোর আকার গোলাকার। বালুময় সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এগুলো। তবে নদী আর সাগরের ঢেউয়ে গোলাকৃতি আকার পাওয়া সাধারণ বড় পাথরগুলোর মতো নয় এগুলো। বহু প্রাচীনকাল থেকে সাগর থেকে আসা নানা ধরনের পদার্থ মিলে একটি পিণ্ডের মতো তৈরি করে। সত্যি বলতে, এই পাথরগুলো যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় একে আপনি তুলনা করতে পারবেন ঝিনুকের মধ্যে মুক্তার সৃষ্টিকে। যেখানে কোনো একটা কিছু অর্থাৎ কেন্দ্রের চারপাশে খনিজের পরত পড়তে থাকে।
ঝিনুকের বেলায় নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে অবাঞ্ছিত কোনো কণা বা বালু। আর মোয়েরাকি পাথরের বেলায় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে ফসিলের খোল বা শেল, হাড়ের টুকরা কিংবা কাঠের টুকরা। সাগরের খনিজ চুন বা অন্যান্য খনিজ, পলি এর ওপর জমতে জমতে গোলাকার বড় এক পাথরে রূপান্তর হয় একসময়।
এমন বিশাল সব পাথর, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কোনো গল্প ছড়াবে না তা কি হয়! যেমন মাওরি আদিবাসীদের ধারণা, কয়েক শ বছর আগে কোনো জাহাজ বিধ্বস্ত হয় এই এলাকায়। ওই জাহাজে থাকা তীরে এসে ভেড়া কুমড়ার মতো কোনো ফলের শরীরে নানা খনিজ ও পলি জমে এ রূপ নেয় কালক্রমে। স্থানীয় কারও কারও ধারণা আবার এই পাথরগুলো আসলে এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীর ডিম। যেসব পাথরে কোনো ফাটল দেখা যায়, সেগুলো ফুটে বাচ্চা বের হয়ে গেছে!
সৈকতের কোথাও নিঃসঙ্গ পাথর দেখতে পাবেন, কোথাও আবার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পাথর এভাবে ছড়িয়ে আছে, দেখে মনে হবে যে কেউ সাজিয়ে রেখেছে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৬ কোটি বছর আগে এগুলোর গঠন বা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিছু কিছু বড় পাথরের গঠন শেষ হতে ৫০-৬০ লাখ বছর লেগেছে বলে অনুমান গবেষকদের। সবচেয়ে বড় পাথরটির ব্যাস দুই মিটার বা ছয় ফুটের বেশি। ওজনে হয় কয়েক টন পর্যন্ত। সাত টনি পাথরও আছে এখানে।
উনিশ শতকের দিকে প্রথম এই পাথরগুলো পরিচিতি পেতে শুরু করে। তখন সৈকতে পাথরের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। তবে মানুষ একটু ছোট আকারের বেশকিছু পাথর বাড়িতে নিয়ে যান স্মারক হিসেবে। এখন অবশ্য মোয়েরাকি পাথর অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য ওজনের কারণে এখানকার কোনো পাথর হাত দিয়ে ওঠানোর সুযোগও সে অর্থে নেই। কিছু পাথর অবশ্য ডুনেডিনের ওটাগো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
অনেকটা এ ধরনের পাথরের মতো দেখতে কওতো বোল্ডার নামে পরিচিত পাথরের দেখা পাবেন নিউ জিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ডের হোকিয়াংগা পোতাশ্রয় এলাকার পর্বত ও বিভিন্ন সৈকতে। মোয়েরাকি পাথর যেখানে পাওয়া যায়, সেখান থেকে ১২ মাইল ভাটিতে অনেকটা এ ধরনের কিছুটা ছোট পাথরের দেখা পাবেন। তবে এগুলোর আকার ভিন্ন। কোনোটি ডিস্কের মতো, কোনোটি উপবৃত্তাকার। ইংল্যান্ডেও কিছু জায়গায় অনেকটা একই ধরনের গোলাকার পাথরের খোঁজ মেলে।
এমনিতে নিউ জিল্যান্ড ঘোরাফেরার জন্য কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও দেশটির বেশির ভাগ প্রাকৃতিক নিদর্শন ও জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে পারবেন নিখরচায়। সাউথ আইল্যান্ডেই নজর কাড়া আরও পাথর দেখতে চাইলে যেতে পারেন পুনাকাইকিতে, সেখানকার পাথরগুলো পরিচিত পেনকেক রক বা পাথর নামে।
মোয়েরাকি পাথরগুলো ভালোভাবে দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে ভাটার সময়। কারণ জোয়ারের সময় কোনো কোনো পাথর কিংবা এদের কিছু অংশ ডুবে যায়। ভাটায় সবগুলোকে প্রকৃত চেহারায় দেখতে পাবেন। সাউথ আইল্যান্ডের ওটাগো অঞ্চলে আছে এই মোয়েরাকি পাথর। মোয়েরাকি ও হাম্পডেনের মাঝখানে কোয়েকোহে সৈকতে দেখা পাবেন এদের। সাউথ আইল্যান্ডের বড় শহর ডুনেডিন, ক্রমওয়েল ও ওমারু থেকে গাড়িতে চেপে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন জায়গাটিতে।
চকলেটের পাহাড়
ফিলিপাইনের বহোল প্রদেশের প্রধান দ্বীপ বহোল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত। উপকূলজুড়ে সাদা বালুর সৈকত টানে পর্যটকদের। তেমনি উপসাগরের স্বচ্ছ জল ডুবুরিদের প্রিয় জায়গা। তবে এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নিঃসন্দেহে চকলেট পাহাড়। না সত্যি সত্যি চকলেটের পাহাড় নয় এগুলো, তবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক ছোট ছোট পাহাড়কে দেখলে মনে হবে যেন চকলেটের তৈরি এগুলো!
এগুলো আসলে ঘাসে ঢাকা মোচাকৃতি ছোট ছোট পাহাড়। ৫০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে এমন ১ হাজার ২৬০টির বেশি পাহাড় আছে। সাধারণত ১০০ থেকে ১৬০ ফুট উচ্চতা হয় পাহাড় বা টিলাগুলোর। তবে সর্বোচ্চ ৪০০ ফুট উঁচু পাহাড়ও চোখে পড়ে। এমনিতে পাহাড়গুলো ঢাকা থাকে সবুজ ঘাসে। তবে শুকনো মৌসুমে এই সবুজ-বাদামি রূপ নেয়। তখনই একে মূলত চকলেটের পাহাড় বলে মনে হয়। তার মানে এর সত্যিকারের রূপ দেখতে আপনাকে যেতে হবে গ্রীষ্মে।
এ ধরনের প্রচুর পাহাড় থাকলেও কীভাবে এদের জন্ম সে সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা আছে এটি তৈরির বিষয়ে। এগুলোর মধ্যে আছে সাগরের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে শুরু করে নানা প্রক্রিয়ায় চুনাপাথরের রূপ পরিবর্তনও।
বেশির ভাগ তত্ত্ব অনুসারে, বৃষ্টি ও ভূত্বকের পানিতে নরম হওয়া চুনাপাথরে টেকটনিক শক্তির প্রভাবে ফাটল ধরে ও ওপরের দিকে উঠে যায়। পরে নদী এবং ঝরনার স্রোতে এগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তৈরি হয় এ ধরনের পাহাড়ের। এ ধরনের পরিবর্তন ককপিট কার্স্ট নামে পরিচিত। এমন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন চকলেট পাহাড়কে। ইদানীং অবশ্য আরেকটি তত্ত্ব বেশ প্রচার পাচ্ছে। সেটি হলো প্রাচীন একটি আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হওয়ার পর এর টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। আর এই টুকরোগুলোই চকলেট পাহাড়।
ছোট পাহাড়গুলোর মাঝখানে চমৎকারভাবে বিন্যস্ত সমতল ভূমি। এ ছাড়া গোটা এলাকাটি প্রচুর গুহা আর ঝরনায় পূর্ণ। তবে বিজ্ঞানীরা যতই তত্ত্ব দেন না কেন, তা চকলেট পাহাড় নিয়ে স্থানীয়দের মুখে মুখে নানান কিংবদন্তি আর গল্পগাথা ছড়ানো আটকাতে পারেনি। এর মধ্যে একটি তো বেশ মজার। বিশাল আকারের দানবীয় এক বুনো মোষ এলাকায় এসে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। এটি এই অঞ্চলের জমির বেশির ভাগ ফসল খেয়ে ফেলে, নতুবা নষ্ট করে। প্রতিশোধ হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু ফসলের মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে রাখে। মোষটার এগুলো খেয়ে পেটে সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় সে যে মল ত্যাগ করে; সেগুলো থেকেই জন্ম চকলেট পাহাড়ের।
এ ধরনের আরেকটি গল্প অনুসারে বিশাল দুই দানবের মধ্যে এখানে তুমুল লড়াই বাধে। এ সময় তারা বিশাল সব পাথর, বালুর স্তূপ ছুড়ে মারে একে অপরের দিকে। কয়েক দিন স্থায়ী লড়াইয়ে দুই দানবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ঝগড়া ভুলে বন্ধু হয়ে যায় তারা। তবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাওয়ার সময় এখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে, তা পরিষ্কার করতে ভুলে যায়। তবে বেশ রোমান্টিক একটি গল্পও আছে এই চকলেট পাহাড় নিয়ে। এক দানব এক তরুণীর প্রেমে পড়ে। কিন্তু যখন মেয়েটি হঠাৎ মারা যায়; সে মনের দুঃখে কাঁদতে শুরু করে। তার চোখের জলের একেকটি ফোঁটা থেকে এক একটি চকলেটের পাহাড়ের জন্ম।
অনেক কিছু তো বলা হলো চকলেট পাহাড় নিয়ে, এবার বরং কীভাবে জায়গাটিতে পৌঁছানো যায় সেটা বলা যাক। ম্যানিলা, ক্লার্ক কিংবা ডাভাও থেকে উড়োজাহাজে চেপে নামবেন বহোল-পাংলাও বিমানবন্দরে। সেখান থেকে যাবেন দাও ইনটেগরেটেড বাস টার্মিনালে। তারপর বাসে চেপে কারমেন শহরে। ওখানেই চকলেট পাহাড় ভিওপয়েন্ট কমপ্লেক্সের অবস্থান। কাজেই সেখান থেকে ইচ্ছামতো ঘুরেফিরে দেখতে পারবেন চকলেটের মতো দেখতে পাহাড়ের মায়াবী রাজ্য।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বিচিত্র