নির্মাতা রেজাউর রহমানের পরিচালনা হাস্যরসাত্মক প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্র ‘৩৬-২৪-৩৬’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ৮ নভেম্বর। রেজাউর রহমান, কারিনা কায়সার ও মোনতাসির মান্নানের রচনায় সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, সৈয়দ জামান শাওন এবং কারিনা কায়সার। সিনেমাটি ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’ প্রজেক্টের পঞ্চম সিনেমা। সিনেমাটি সম্পর্কে জানাচ্ছে গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।
গল্প: রোমান্টিক কমেডি ঘরানার ‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমা নির্মাণ করেছেন রেজাউর রহমান। সায়রা, প্রিয়ন্তি আর তাহসিরকে ঘিরে এই ছবি। সায়রা অনলাইন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত, তিনি ওয়েডিং প্ল্যানার হিসেবেও সফল হন। এক ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, চার বছর তিনি ট্রমা থেকে বের হতে পারেন না। শারীরিক গঠনের কারণে তার ছবি ফেসবুকে না দিয়ে প্রজাপতির ছবি দিয়ে রাখতেন। গিফট বক্স পাঠানোর মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাহসিরের সঙ্গে। সায়রা দেখা করতে চান না তার সঙ্গে। তবে তাহসিরের জন্মদিনে তাদের দেখা হয়। এরপর জানা যায় তাহসির হাসপাতালে। তার মোবাইল নম্বর বা ফেসবুক বন্ধ। একদিন তাহসিরের মৃত্যু সংবাদ পায় সায়রা, তাহসিরের বন্ধু নীরবের কাছ থেকে। তারা কবরস্থানে যায়, তাহসিরের জন্য কোরান পড়ে দোয়া করে। এর চার বছর পর একদিন প্রিয়ন্তির বিয়েতে সায়রার সঙ্গে দেখা হয় তাহসিরের। তিনি মারা যাননি! শুরু হয় ছবির আসল গল্প! সিনেমার গল্পে আহামরি কোনো টুইস্ট নেই। কিন্তু সিনেমায় একটা বার্তা রয়েছে যা বেশ শক্তিশালী। প্রথাগত গল্পের বাইরে গিয়ে ভিন্ন স্বাদের গল্পের সিনেমা নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা রেজাউর রহমান। সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারনার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে সিনেমার গল্প। সমাজে সৌন্দর্য নিয়ে যে ট্যাবু বিদ্যমান সেখানে ধাক্কা দিয়েছে সিনেমার গল্প। গল্পের মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন কারিনা কায়সার। এই চরিত্রটি ঘিরে সিনেমার গল্প। সিনেমাজুড়ে সমাজে মানুষের শরীর নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ তুলে ধরেন নির্মাতা। এই সিনেমা অনেক মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা জাগাবে।
অভিনয়: বাংলা সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা নায়িকা সবসময় ফিটফাট এবং গ্ল্যামারাস হবে এমন ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে সেট হয়ে আছে। প্রার্থনা ফারদিন দীঘি এই সিনেমায় যুক্ত হওয়ার পর আমারও এমনটা ধারণা হয়েছিল। সিনেমা দেখা শুরু করার পর থেকে তা বদলে যায়। সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন কারিনা কায়সার। সিনেমার মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। যিনি সিনেমায় একজন মেধাবী ও সফল ওয়েডিং প্ল্যানার। সায়রার ভূমিকায় কারিনা কায়সার নিখুঁত অভিনয় করেছেন। অভিনয় এতটাই প্রাণবন্ত এবং আবেগপূর্ণ ছিল যে সায়রার প্রতিটি অনুভূতি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কারিনা কায়সার চরিত্রের ইমোশন খুবই নিখুঁতভাবে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কারিনা কায়সারের পিতা ফুটবলার কায়সার হামিদও একটি অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার কারিনা কায়সার আর পর্দার কারিনা কায়সারের মধ্যে বেশ পার্থক্য। সামনের দিনে তার কাজ দেখার জন্য আগ্রহ জন্মেছে। প্রার্থনা ফারদিন দীঘি ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন। চরিত্রটার মধ্যে একটা বাচ্চামি ব্যাপার ছিল যা তিনি অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজের ভয়েস নিয়ে আরেকটু কাজ করতে পারতেন। সৈয়দ জামান শাওন চিরচেনা অভিনয় করেছেন। চরিত্রে নতুনত্ব নেই। আবু হুরায়রা তানভীর শাওনের বন্ধু চরিত্রে বেশ ভালো পারফর্ম করেছেন। এছাড়া গোলাম কিবরিয়া তানভীর, মিলি বাশার, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, শহীদুল আলম সাচ্চু, রোজী সিদ্দিকী, শামীমা নাজনীন সহ তরুণ-প্রবীণ সকলে স্ব স্ব চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।
টেকনিক্যাল দিক: রেজাউর রহমানের কাজের মধ্যে একটা দিক লক্ষণীয় তিনি টেকনিক্যাল দিকে বেশ নজর দিয়ে থাকেন। এ ছবির গল্প লিখেছেন তিনজন কারিনা কায়সার, মোনতাসির মান্নান এবং রেজাউর রহমান। সিনেমার চিত্রনাট্য ও স্ক্রিন প্লে বেশ গোছানো ছিল।
তরুণ এই নির্মাতা নিজের প্রতিটি কাজে চিত্রনাট্যের দিকে বেশ নজর রাখেন, ‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ক্যামেরার কাজ ভালো ছিল। ক্যামেরা হাতে রাজু নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন বরাবরের মতো। চট্টগ্রামের মাটিটা ইকো রিসোর্টে হয়েছে অধিকাংশ শুটিং। পুরো লোকেশনটা বেশ ভালোভাবে ক্যাপচার করেছেন রাজু রাজ। সিনেমার কালার গ্রেডিং নিয়ে আরেকটু কাজ করার সুযোগ ছিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। সিনেমার আর্টের কাজ বেশ ভালো লেগেছে। সিনেমার সঙ্গীত নিয়ে আলাদা করে বলতে হয়। প্রথম গান ‘তোমাকে চাই না’ মাশা ইসলাম ও সন্ধীর দ্বৈত কণ্ঠে এতটাই শ্রুতিমধুর ছিল পুরো হলভর্তি দর্শক গুণগুন করতে থাকে।
তোমাকে চাই /নাকি চাই না /আমি বুঝি না নিজেরই মন /তোমার কথায় এ মুখে হাসি /কেন লেগে থাকে সারাক্ষণ…
‘মিস করোনা ফ্রান্স’ গানের কথা লিখেছেন মুকুট মাসরুর এবং কাহজীব নুরুল মোমেন। গেয়েছেন নিলয় আহমেদ ও মিলিনা মোমিন। শেখ শফি ও শেখ সামি মাহমুদ ছিলেন সঙ্গীতে। ‘হলুদ হলুদ ড্যান্স’ শিরোনামে গানটি পুরো ওয়েডিং সং হয়েছে। সিনেমার মিউজিক ডিপার্টমেন্ট বেশ মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
নির্মাণ: রেজাউর রহমানের প্রতিটি নির্মাণ আগের কাজের থেকে আলাদা হয়। ‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ভিন্নধর্মী একটা গল্প নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। সিনেমার চিত্রায়ন, আবেগময় সঙ্গীত এবং দৃশ্যের বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে যে সব শ্রেণির দর্শক প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা সায়রার যাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছে। দর্শকদের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। রেজাউর রহমান নিজের নির্মাণ দিয়ে আবারও দর্শকদের মন জয় করলেন এটা বলতেই হয়। একটা ভালো দিক তিনি শ্রোতের বিপরীতে হাঁটেন, এজন্যই তিনি সবার থেকে ব্যতিক্রম কাজ উপহার দিতে পারেন।
ভালো দিক: ‘৩৬-২৪-৩৬’ চলচ্চিত্রটি একজন মানুষের সৌন্দর্য এবং আত্ম-মূল্যের প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে আত্ম-গ্রহণের একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করেছে। যা যেকোনো শ্রেণির দর্শকের মনে ধাক্কা দিবে আর একটি বার্তা দিবে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা সায়রার নিজের প্রতি ভালোবাসার গল্পটি দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অজস্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। অনেকে সিনেমা দেখার পর বলবে, সায়রা পারলে আমিও পারবো। সিনেমার শেষে নির্মাতা উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছেন দর্শকদের এটাই এই সিনেমার স্বার্থকতা।
‘৩৬-২৪-৩৬’ চলচ্চিত্রটি কারিনা কায়সারের অসাধারণ অভিনয় এবং রেজাউর রহমানের দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে প্রাণবন্ত হয়েছে। সিনেমাটি দেখার পর যেকোনো শ্রেণির দর্শকের মনে একটি স্থায়ী ছাপ ফেলবে এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে।
খারাপ দিক: ‘৩৬-২৪-৩৬’ সিনেমাটি মূলত ওটিটি কনটেন্ট হিসেবে নির্মাণ করা হয় তা তারপর বড় পর্দায় মুক্তি পায়। সিনেমাজুড়ে কাজের মধ্যে একটা ওটিটি কনটেন্ট আবহ ছিল। বলা যায় ওটিটি কনটেন্ট সিনেমার নামে চালানো হয়েছে। সিনেমার গল্প থেকে অভিনয় কিংবা নির্মাণ কোনোকিছু নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই তবে বড় পর্দার কাজে আলাদা আমেজ থাকে, যা এই কাজে অনুপস্থিত ছিল। এটা সব শ্রেণির দর্শকের সিনেমা না, সেজন্য এটা বড় পর্দায় তুলনামূলক সাড়া ফেলতে পারেনি। সিনেমায় সিনিয়র শিল্পীদের খুব কম ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের আরও ব্যবহার করার সুযোগ ছিল।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনোমালজি