ভূমিকম্প, পেঁয়াজ ও চার্লসের রাজমুকুট

মাহবুব আলম

ভূমিকম্প

গত ৫ মে শুক্রবার ভোরে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে ঢাকা। ভোর পাঁচটা ৫৭ মিনিটে আচমকা কম্পনে ঘুম ভেঙে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। রিকটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। ওই ভূমিকম্পে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে উচ্চ ভবনগুলোতে তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। অনেকেই আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসেন। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকার পার্শ্ববর্তী দোহার থেকে ১৪ দশমিক দুই কিলোমিটার পূর্বে। ঢাকার আজিমপুর থেকে ২৩ দশমিক চার কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে। এবং নারায়ণগঞ্জের ২৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে। তবে ভূমিকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে এটা ছিল মৃদু ভূমিকম্পন। আরো বলা হয়েছে এর আগে ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের তারাবো অঞ্চলে ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

গত এক যুগে ঢাকা ও তার আশপাশে আটটি ভূমিকম্পন অনুভূত হয়েছে। এর সবগুলোই উৎপত্তি স্থল ছিল ঢাকার বাহিরে সিলেট নয়তো চট্টগ্রাম। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে ঢাকায় যে ভূমিকম্প হলো তার উৎপত্তি স্থল ঢাকা। রীতিমতো বিপদজনক। কারণ ঢাকা ও তার আশপাশে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ২১ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ হচ্ছে ছয় তলা ও এর অধিক উচ্চতাসম্পন্ন। কয়েক বছর আগে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ঢাকা ও তার আশেপাশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই প্রস্তাবের কার্যকারিতা চোখে পড়ার মতো নয়। সম্প্রতি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর আবারও বুয়েট ওই প্রস্তাব দিয়ে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার তাগিদ দিয়েছে। এই বিষয়ে রাজউকের দাবি তারা ৩০০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছে।

এক খবরে জানা গেছে দেশের ১৩টি অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রাম। কিন্তু এ বিষয়ে সচেতনতা একেবারে কম। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে এই সাধারণ বিষয়টিও অনেকে জানে না। আর এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য যে প্রস্তুতি সেটা একেবারেই অপ্রতুল। অথচ আমরা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছি। এই বিষয়টি সাধারণভাবে ব্যাপক আলোচিত না হলেও এ নিয়ে যথেষ্ট আতঙ্ক আছে। এই আতঙ্ক দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পেঁয়াজ সিন্ডিকেট

বাঙালির রন্ধনশালায় পেঁয়াজ এক প্রয়োজনীয় বস্তু। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বারবার পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি করে বছরের পর বছর ব্যবসার নামে লুটপাট করছে। এই লুটপাটকারীদের বলা হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেট। এই বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এত বেড়েছে যে এরা কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। তার বড় প্রমাণ দেশের বাম্পার ফলনের পরও পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি। এই মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ বৃদ্ধি নয়। খোদ টিসিবির মতে গত এক মাসে দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১২১ শতাংশ। অর্থাৎ এই মূল্য বৃদ্ধি দ্বিগুণেরও বেশি।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এপ্রিলের শেষ থেকে মে’র শেষ এক সপ্তাহে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এইসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেকেই আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে এর জন্য দায়ী করছেন। সে যাই হোক, প্রশ্ন হলো বাম্পার ফলনের পেঁয়াজ গেল কোথায়? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। অবশ্য নেই তা নয়; খোদ এক মন্ত্রী এর উত্তর দিয়েছেন। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার এজন্য দায়ী করেছেন বাজারের সিন্ডিকেটকে। এই ঘটনার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যদি সরকার জানে যে, পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বাজার সিন্ডিকেট দায়ী তাহলে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? কখনো কখনো বলা হয়, বলার চেষ্টা করা হয়, বাজার সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সরকারের চাইতে বেশি শক্তিশালী নয়। বলা হয় এদের হাত খুব লম্বা। কিন্তু আমরা জানি সরকারের হাত তার চাইতেও অনেক লম্বা। এই যখন অবস্থা তখন আমরা এজন্য কাকে দায়ী করব?

এই বাজার সিন্ডিকেট আদা, রসুন থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি করে প্রতিবছর হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ কোটি টাকা লুট করছে। এই লুটেরাদের চিহ্নিত করে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো আম জনতাকে বাজারে গিয়ে চোখের জল ফেলতে হবে বছরের পর বছর। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এখন তাই হচ্ছে। খোদ শিল্প প্রতিমন্ত্রী একথা বলেছেন। তিনি  বলেছেন, আমি দেখেছি বাজার করতে গিয়ে মানুষ কাঁদছে। তাদের কাছে বাজার করার মতো টাকা নেই।

চার্লসের মাথায় রাজমুকুট

পশ্চিমারা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলে। আর ওই কথিত গণতন্ত্রের পূর্বভূমির দাবিদার ইংল্যান্ড তথা গ্রেট ব্রিটেনে আজও রাজতন্ত্র বহাল তাবিয়েতেই আছে। আছে তাদের ঠাঁট-বাট জৌলুসপূর্ণ জীবন। সেই সাথে সর্বোচ্চ রাজকীয় মর্যাদা।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশ্বের দেশে দেশে রাজা রানির শাসন তথা রাজতন্ত্রের পতন শুরু হয়। সেই পতন একবিংশ শতাব্দীতেও অব্যাহত আছে। আমার জানামতে, সর্বশেষ রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে হিমালয়কন্যা নেপালে ২০০৬ সালে। তারপরও অনেক দেশে রাজা-রানি আছে। অনেকেই আবার কৌশল করে এই রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। যারা কৌশল করে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে তাদের মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম।

খোদ ব্রিটেনও রাজতন্ত্র পুরোপুরি বিলোপের দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে জনমত গড়ে উঠেছে। আর তাইতো রাজা তৃতীয় চার্লসের সিংহাসনে আরোহণ ও শপথগ্রহণে জনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে পড়তে হলো। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ২০০২ সালে কাঠমান্ডুতে রাজা জ্ঞানেন্দ্র’র অভিষেক অনুষ্ঠানে। শুধু তাই নয় বিক্ষোভের ডাক ও নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রাজতন্ত্রবিরোধী গ্রুপের নেতাসহ অত্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, শুধু লন্ডন নয় ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

৬ মে শনিবার ব্রিটেনের ৪০তম রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লস সিংহাসনে আরোহণ করেন আনুষ্ঠানিকভাবে। এই সিংহাসন আরোহণ অর্থাৎ অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছে খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ৬১ দেশের সরকার প্রধানসহ ২০৩টি দেশের প্রতিনিধিরা। ধর্মীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সর্বমোট ২২০০ জন অতিথি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন। লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে গির্জায় দুই দফা শপথ গ্রহণের পর রাজা চার্লসের মাথায় ৩৬০ বছরের পুরোনো রাজমুকুট পরিয়ে দেন ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। তারপর কুইন কনসর্ট ক্যামেলা পার্কারের মাথায় মুকুট পরানো হয়।

গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বরের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর চার্লস রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেন। ৬ মে সেই দায়িত্ব পাকাপোক্ত হয় আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে। শপথগ্রহণের পর রাজা-রানি স্বর্ণখচিত ঘোড়ার গাড়িতে বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে ফেরেন। সেই সময় রাস্তায় দুই পাশে দণ্ডায়মান জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে নতুন রাজা-রানিকে অভিনন্দন জানান। পরে তিনি প্রাসাদের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার দিকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন। গণতন্ত্র ও মানবতার এই যুগে আধুনিক বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সাক্ষী হয় এই রাজকীয় মহা উৎসবের!

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 10 =