মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে মানুষের উদ্বেগ

মুশফিকুর রহমান: ভাসমান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা এবং ক্ষতিকর গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে মহানগরী ঢাকাসহ বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ এখন বৈশ্বিক বায়ুমান সূচকের শীর্ষে। তুলনামূলক কম শিল্পঘন দেশে বায়ুদূষণের এই তীব্রতা নিশ্চিতভাবে বৈশ্বিক গবেষণার বিষয়। এর মধ্যেই ঢাকার বায়ুমান নিয়ে আরও এক দফা মন্দ খবর জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ। তাদের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার (নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরসহ) বাতাসের নমুনা বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীগণ অতিসূক্ষ্ম প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। ভাসমান সূক্ষ্ম বস্তুকণা হিসেবে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বাতাসে ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করছে। মানুষের খাদ্যশৃঙ্খল দিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করছে এবং তা নিয়ে বিস্তারিত নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানবশরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক অনুপ্রবেশ করতে থাকলে তা খাদ্যশৃঙ্খল হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবেশের চেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘটবে এবং এর বৈরী প্রভাব প্রকটতর হবে।

পরিবেশে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক উপাদানসমূহ সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগত ভেঙে ছোট ছোট টুকরা হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে চুলের চেয়ে ক্ষুদ্র উপাদানে পরিণত হয়। সূক্ষ্ম এ সকল প্লাস্টিক কণা সহজেই বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা হিসেবে দূষণের কারণ হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক সারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ায়; তুষারাচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গ, সমুদ্রতল, বন এবং লোকালয় সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। জাপানের কিউসু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ গত বছর এক গবেষণায় পরিমাপ করেছেন যে পৃথিবীর মহাসমুদ্র পৃষ্ঠে প্রায় ২৪.৪ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক (আনুমানিক ৩০ বিলিয়ন আধা লিটার পানির বোতল) সঞ্চিত হয়েছে। প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে এবং দিন দিন তার পরিমাণ বাড়ছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বে ৩৬৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ তিনগুন বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে (ডিসেম্বর ২০২১) ২০০৫ সালে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বছরে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৩ কিলোগ্রাম। ২০২০ সালে সে পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাথা প্রতি ৯ কিলোগ্রাম (ঢাকা নগরীতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পরিমাণ বছরে মাথাপ্রতি প্রায় ২২ কিলোগ্রাম)। ২০২০ সালে দেশে ব্যবহৃত প্রায় ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের মধ্যে প্রায় ৩১% পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিবেচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের বাৎসরিক গড় বছরে মাথাপ্রতি প্রায় ১০০ কিলোগ্রাম। তবে প্লাস্টিক দূষণের বিবেচনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্লাস্টিক দূষণের অন্যান্য প্রভাবের পাশাপাশি শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ এখন প্লাস্টিক বর্জ্য।

২০১২ সালে কানাডার মন্ট্রিল নগরীতে ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ ঘোষণায় বলা হয়েছিল: সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ, ৪৫% শতাংশ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ২১% শতাংশ সামুদ্রিক পাখি প্লাস্টিক উপাদানে জড়িয়ে অথবা প্লাস্টিক উপাদান খেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ব্যাপকতা বাড়ছে। বাড়ছে সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীদের দূষণাক্রান্ত হবার ব্যাপ্তি।

মানুষের শরীরে প্লাস্টিক অনুপ্রবেশ করলে তার ক্ষতির ধরন এবং ব্যাপ্তি পরিমাপ তুলনামূলকভাবে জটিল। গবেষণাগারে পরীক্ষায় স্পষ্ট, মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে মানুষের শরীরে কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কোষে অ্যালার্জি সৃষ্টি হয় এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার যত বাড়বে, পরিবেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক তত বেশি ছড়াবে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান (প্লাস্টিক তৈরির জন্য খনিজ হাইড্রোকার্বন ব্যবহৃত হয় ফলে প্লাস্টিকে বিভিন্ন খনিজ ও রাসায়নিক উপাদান উপস্থিত থাকে। তাছাড়া, দৃঢ়তা, স্থিতিস্থাপকতার গুন যুক্ত করবার প্রয়োজনে প্লাস্টিক উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘অ্যাডিটিভ’ যোগ করা হয়)। মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে শরীরে রোগ-জীবাণুর অনুপ্রবেশ বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক, অ্যালার্জি ও অ্যাজমা গবেষণা কার্যক্রমের পরিচালক ক্যারি নাডিউ মানুষের ফুসফুসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যাজমা, মাথাব্যাথা, ঝিমুনি এবং ক্যান্সার আক্রান্ত হবার সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। কোনো কোনো মাইক্রোপ্লাস্টিক যেমন, অগ্নিপ্রতিরোধী প্লাস্টিক উপাদানসমূহের অতিসূক্ষ্ম কণা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে গর্ভে থাকা ভ্রুণ এবং শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।

‘জার্নাল অব হ্যাজার্ডাস ম্যাটেরিয়লস’ এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে (দি গার্ডিয়ান, ৮ ডিসেম্বর ২০২১) যুক্তরাজ্যের ‘হাল ইয়র্ক মেডিকেল স্কুল’ এর ইভানগোলাস ড্যানোপোলসকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, ‘পরিবেশে প্লাস্টিক থাকলে আমাদের তা থেকে নিষ্কৃতি নেই। আমরা অতিক্ষুদ্র এই প্লাস্টিক কণা শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাদ্যবস্তুর সাথে শরীরে গ্রহণ করছি। আমাদের উদ্বিগ্ন হবার কারণ ঘটছে। এ মুহূর্তে আমাদের মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ থেকে দূরে থাকার পথ জানা নেই। ভবিষ্যতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণাক্রান্ত খাদ্য চিহ্নিত করা এবং তা পরিহারের পথ আবিষ্কৃত হবে।’

মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে এবং মানুষের শরীরে তার অনুপ্রবেশজনিত সমস্যার স্বরূপ উন্মোচনের টুকরো খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানার সুযোগ বাড়ছে। ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এই ছোট্ট নীতিগত ঘোষণা দেবার আগে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণের যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। তবে ক্ষতির স্বরূপ উম্মোচনে যত সময় লেগেছে সে সময়ে ধূমপায়ীদের শারিরীক ক্ষতি থেমে থাকেনি বরং বহুগুন বেড়েছে। সে কারণে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ মানুষের জন্য কী ধরনের ক্ষতির কারণ হয় তা জানার চেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সে সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও জরুরি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − 5 =