মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ

সালেক সুফী

প্রাকৃতিক কারণ, মানুষের স্বেচ্ছাচার বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে এনেছে। বিশ্বজুড়ে অনিয়ন্ত্রিত বৈষয়িক উষ্ণতা বৃদ্ধি, এর সঙ্গে বাংলাদেশে নির্বিচার বৃক্ষ নিধন, জবর দখলের মাধ্যমে নদী, জলাশয়ের অপমৃত্যু ঘটনায় শীতকালে শীতের তীব্রতা, গ্রীষ্মে দাবদাহ এবং বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি বন্যার কবলে পরে বাংলাদেশ এখন গভীর সংকটে।  ২০২৪ সালেই দেশে শীতের তীব্রতা এবং এপ্রিল মাসে দাবদাহ নতুন মাইল ফলক সৃষ্টি করেছে। অনেকের ধারণা এবারে অতিবৃষ্টির কারণে প্রলয়ংকারী  বন্যা যানমালের বিপুল ক্ষয় ক্ষতি করতে পারে। বৈষয়িক বিষয়গুলো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।  কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচার, সম্পদ অর্জনের লালসা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর যথাযথ পরিকল্পনা তথা মনিটরিং ব্যাবস্থার অভাবে জাতীয় সংকটে পরিণত পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে এখন প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ।

পরিবেশ রক্ষার জন্য জাতীয় আন্দোলন। দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, দেশ না বাঁচলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ জীবন সব বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।  সরকারের নিঃসন্দেহে প্রধান দায়িত্ব।  কিন্তু পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মিডিয়াগুলোর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। দেশে বাস্তবায়িত অধিকাংশ মেগা অবকাঠামোগুলো পরিকল্পনা কালে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা  হয়নি। নগরায়নের অজুহাতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে সবুজ শহর নগরগুলোকে কংক্রিকেটের জঙ্গল তথা গ্যাস চেম্বার বানানো হয়েছে।

এমনিতেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বহমান নদ নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত জল প্রবাহ সংকুচিত করেছে। উপরন্তু একশ্রেণির   নদী জলাধার খেকো দখলদার সিন্ডিকেট নদী জলাশয়গুলোকে অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।  সীমিত সড়ক মহাসড়কে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ফসিল ফুয়েল পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করছে। পরিস্থিতি এমন যে বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেই আশু মুক্তি মিলবে না। ঢাকা মহানগরী সহ পুরো দেশকে বিদ্যমান পরিবেশ দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে জাতীয় মহাপরিকল্পনা গ্রহণ। সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করে পেশাদারদের মাধ্যমে সমন্বিত ভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবুজায়ন করতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। ক্ষুদ্র দেশ, বিশাল জনগোষ্ঠী। সীমিত এলাকায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, বস্ত্র , স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার অনেক চ্যালেঞ্জ। সবাই জানে সবুজ বৃক্ষ রাজী অক্সিজেন সরবরাহ করে। কার্বন ডাই অক্সাইড সহ ক্ষতিকর পরিবেশ দূষণকারী গ্যাসগুলো শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একই সঙ্গে নদী, জলাশয়গুলো পরিবেশ সুশীতল রাখায় বিশাল ভূমিকা পালন করে।

ষাট দশক থেকে ঢাকায় থাকা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একসময় সবুজের সমারোহ, নদী, খাল বিলের কল্যাণে ঢাকা ছিল তিলোত্তমা শহর। স্বাধীনতার পর থেকেই অপরিকল্পিত নগরায়ন, তথা শিল্পায়নের অশুভ প্রভাবে পরিবেশ ধ্বংস হতে থাকে। ঢাকা থেকে ক্রমাগত বৃক্ষরাজি নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়। চারপাশে বহমান নদীগুলো জবরদখল করা হয়। ঢাকার বুকে বহমান খালগুলোকে ধ্বংস করা হয়।

কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনে অসংখ্য পরিবেশধ্বংসী বহুতল অট্টালিকা গড়ে ঢাকাকে গ্যাস চেম্বার বানানো হয়। আধুনিক নগরগুলোর নগরায়নের বিচারে ঢাকার সব ধরনের নাগরিক পরিষেবা ক্ষমতা বিবেচনায় সর্বোচ্চ এক কোটি মানুষ বসবাস করা যুক্তিযুক্ত। সেখানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। নাগরিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর পক্ষে কোনভাবেই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ,পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও শহরের অকল্পনীয় যানজট, শব্দজট, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সামান্য বৃষ্টি হলেই ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। অসংখ্য পরিবেশ দূষণকারী যানবাহন ঢাকার বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এই মহানগর তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত হয়েছে নিজেদের ভুলে। সরকার, রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সুধী সমাজ, মিডিয়াগুলো সত্যিকার অর্থে জনসচেতনা সৃষ্টি করতে পারেনি। ১৯৭০ দশকে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুলালালামপুর ঢাকা থেকে ভিন্ন ছিল না। এখন ওই শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকার তুলনায় হতে পারে না।

যা হওয়ার হয়ে গাছে। ঢাকাসহ বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে সরকারকে অবশ্যই পরিবেশ বিপর্যয়কে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে জাতিকে সঙ্গবদ্ধ করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেশকে সবুজায়ন করতে সর্বত্র পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক বনজ, ফলজ এবং ভেষজ বৃক্ষ রোপন করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। পরিকল্পিত পন্থায় পরিবেশসম্মত উপায়ে নগরায়ন এবং শিল্পায়ন করতে হবে। নদী জলাধার সংরক্ষণ এবং দূষণমুক্ত রাখার জন্য নিবিড় মনিটরিং করতে হবে। ঢাকা সহ সকল মহানগরী এবং শহরগুলোতে চলাচল করা পরিবেশ দূষণকারী যানবাহন পরিবেশবান্ধব যানবাহন দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

সর্বোপরি নগর-গ্রামাঞ্চল নাগরিক রিভার্স মাইগ্রেশন সৃষ্টি করে নগরীর জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতায সীমিত করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে গ্রামগুলোতে শহরের নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামগুলোর উন্নয়ন সর্বতভাবে সবুজ উন্নয়ন হতে হবে। কেবলমাত্র জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই এটি সম্ভব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − four =