মায়া আর জঞ্জালে ঘেরা পাঁচ মানুষের গল্প

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত: আর্টহাউস চলচ্চিত্রের বিশ্বসেরা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ‘মুভি ডটকম’। যেখানে বিশ্বের অবিশ্বাস্য সুন্দর ও আকর্ষণীয় সিনেমার তালিকায় রাখা হয়েছে ‘মায়ার জঞ্জাল’কে। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর হাতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি ছোট গল্প ‘বিষাক্ত প্রেম’ ও ‘সুবালা’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘মায়ার জঞ্জাল’ চলচ্চিত্রটি। সিনেমাটি বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি।

‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমাটি আমাদের আশেপাশে প্রবাহমান ঘটনা দিয়েই সাজানো। সিনেমায় পাঁচটি মানুষের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত এক নিম্নবিত্ত দম্পত্তির, দ্বিতীয়ত এক মাস্তানের, তৃতীয়ত এক ব্যবসায়ীর আর সর্বশেষে এক যৌনকর্মীর। বলতেই হয় চরিত্রগুলো খুবই নিখুঁত ভাবে পর্দায় স্টাবলিশ করা হয়েছে। যার ফলে চরিত্রগুলো একপর্যায়ে খুব আপন হয়ে ওঠে।

সিনেমার গল্প খুবই সাধারণ ও চিরচেনা। গল্প বলার ধরন ছিল বেশ সুন্দর। নির্মাণশৈলী ছিল মুগ্ধ করবার মতো। সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে ‘চাঁদু-সোমা’ দম্পতিকে ঘিরে। জীবনে নানান ধরনের সমস্যা তাদের আঁকড়ে ধরে আছে। কখনো পারিবারিক আবার কখনো সামাজিক আর অধিকাংশ সময় অর্থনৈতিক। সমস্যা বাড়তে থাকে আর কমতে থাকে তাদের ভালোবাসা। কিন্তু কোথায় যেন রয়ে আছে মায়া। নিজের কষ্টের সময়গুলোতে পাশে পায় না স্বামীকে। হঠাৎ স্মৃতি হিসেবে ভেসে উঠে অতীতের দিনগুলোর কথা। স্বামীর সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আয় রোজগার শুরু করে পুরোদমে। নির্মাতা খুবই নিখুঁত ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাদের দুজনের সম্পর্কে মায়া ছাড়া আর কিছুই নেই। নির্মাতা যৌনকর্মীর মাধ্যমে দুটি চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন দর্শকদের সঙ্গে। যৌনকর্মীর গল্পটা বেদনাদায়ক। নিজের স্বামী তাকে বিক্রি করে দিয়ে বাধ্য করেছে যৌনকর্মী হতে। দৈনন্দিন জীবনে কেউ স্বামীর কথা বললে চরম রেগে বসেন তিনি। আবার নিজেই স্বামীর ভালো স্বভাবের কথা বলতে থাকেন গরগর করে। ভালোবাসা নামক শব্দটা তারা জীবন থেকে দূরে রাখতে চায়। এক মায়ার ছলনায় আটকে থাকা জীবন এই যৌনকর্মীর। সিনেমার এক পর্যায়ে যৌনকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় এক মাস্তানের। বহুদিন একসঙ্গে কাটিয়েছে তারা দুজন। নিয়মিত বিভিন্ন মানুষকে বিপদে ফেলে দেওয়া মাস্তানের রোজকার ঘটনা। কিন্তু ভালোবাসা আর মায়ার মিশ্র অনুভূতির কারণে যৌনকর্মীকে বিপদে ফেলতে পারে না সে। সিনেমার একপর্যায়ে যৌনকর্মীর মাধ্যমে এক ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে স্ক্রিনে। টাকাপয়সা ওয়ালা এই ব্যবসায়ী বিবাহিত জীবনে অসুখি। শহরের নানান জায়গায় ভালোবাসা খুঁজে বেড়ান তিনি। চরিত্রটা এটাই বুঝিয়েছে উচ্চবিত্তের জীবনও একেবারে সহজ না। তাদের জীবনে পরিশ্রম, বিরক্তি, চিন্তা, ভালোবাসা রয়েছে। আছে মায়া।

‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমায় দুই বাংলার অভিনেতাদের একফ্রেমে দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশের অপি করিমের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের সোহেল মণ্ডলের সঙ্গে অভিনয় করেছেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ। অপি করিম ও ঋত্বিক চক্রবর্তী দুজনেই পরীক্ষিত শিল্পী। নিজেদের কাজটা স্ক্রিনে তারা খুবই সূক্ষ্ম ভাবে করতে জানেন। এখানেও তাই ঘটেছে। ‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমার মাধ্যমে প্রায় দুই দশক পর বড় পর্দায় ফিরলেন অপি করিম। সিনেমায় তার লুক, ডায়ালগ ডেলিভারি ও ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন মুগ্ধ করেছে। চরিত্রের জন্য তার চেহারায় অসহায়ত্বের ছাপ ডিমান্ড করে। তিনি তা পুরোটা সময় জুড়ে সমানতালে করে দেখিয়েছেন। সিনেমায় ‘সোমা’ চরিত্রে আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স করেছেন অপি করিম। তিনি ফিরলেন চিরচেনা রূপে বলতেই হয়। কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীকে দেখা যায় অপি করিমের স্বামীর চরিত্রে। ‘চাঁদু’ চরিত্র দেখা যায় তাকে। এই ভদ্রলোক একটা জাত শিল্পী। স্বয়ং অপি করিম শুধুমাত্র ঋত্বিক চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করবেন এই লোভ সামলাতে না পেরে সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পর্দায় তার উপস্থিতি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে গল্পে। বরাবরের মতোই ন্যাচারাল পারফরম্যান্স করেছেন তাকদীর খ্যাত অভিনেতা সোহেল মন্ডল। তাকে দেখা যাবে এই সিনেমায় মাস্তান চরিত্রে। গেটআপ আর লুকে ছিল পরিপক্বতার ছাপ। চরিত্রের সঙ্গে খুবই সূক্ষ্ম ভাবে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। কলকাতার চান্দ্রেয়ী ঘোষের পারফরম্যান্স ছিল টপনচ। একজন যৌনকর্মী নারীর চরিত্রের সঙ্গে এতটা নিখুঁত ভাবে মিশে গিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা করতেই হয়। সংলাপ প্রয়োগ থেকে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন কিংবা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সবকিছুতে ছিল পরিপক্বতার ছাপ। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন সোহেল মণ্ডল। দুজনের স্বল্প সময়ের রসায়ন মন্দ লাগেনি। কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাবলীল অভিনয় করেছেন যখনই উপস্থিত হয়েছেন। এছাড়া বাকিরা স্ব স্ব চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।

‘তুমি তো সবই বোঝ, আমায় খালি বোঝ না’ এমন কথায় ‘সহজ গান’ শিরোনামের দেবদীপ মুখার্জীর কণ্ঠের গানটি শুনতে বেশ ভালো লেগেছে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, কালার গ্রেডিং, সিনেমাটোগ্রাফি সবকিছুই ছিল ঠিকঠাক। সিনেমার স্টোরি টেলিং ছিল এককথায় অসাধারণ। এতটা সুন্দর ভাবে গল্প বলা হয়তো ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী বলেই সম্ভব হয়েছে। সিনেমার ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট খুবই সুন্দর ছিল। এককথায় আরও একটা অসাধারণ নির্মাণ করলেন ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ‘ফড়িং’ ও ‘ভালোবাসার শহর’র পর।

ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী নিজের ভাষায় ‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমার মাধ্যমে জানান দিলেন আমাদের প্রবাহমান জীবনে ভালোবাসা নেই, আছে শুধু মায়া ও তার জঞ্জাল। আমাদের জীবনে বিশেষ কোনো ঘটনা স্বল্প সময়ের তৃপ্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু বিশেষ মুহূর্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। মোটাদাগে বলতে হয় সকল শ্রেণির দর্শকদের জন্য সিনেমাটি নয়। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি সিনেমাটা দেখে নিজের মতো ভাববে। সিনেমাটির নেগেটিভ দিক নেই বললেই চলে। সবকিছুর মিশেলে প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির একটা উপভোগ্য সিনেমা।

ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সিনেমাটি ইতালির রোমে এশিয়াটিকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রতিযোগিতা বিভাগ ‘এনকাউন্টার উইথ এশিয়ান সিনেমা’য় বেস্ট ফিচার ফিল্ম জুরি অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এশিয়ান কমপিটিশনে প্রতিযোগিতা করে চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার পেয়েছে।

সিনেমা: মায়ার জঞ্জাল, পরিচালক: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট, চিত্রনাট্যকার: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ও সুগত সিনহা
অভিনয়: অপি করিম, ঋত্বিক চক্রবর্তী, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, সোহেল মণ্ডল, শাওলি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eighteen + 16 =